হাসান ইকবাল
কমলাপুর আন্তর্জাতিক বাস টার্মিনালে রিপোর্টিং ২৩ আগস্ট বিষ্যুদবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। সেখান থেকে ভুটান যাবার বাস ছাড়বে সাড়ে ৭টায়। বিকাল তিনটা থেকে বসে আছি যমুনা ফিউচার পার্কে, ভারতীয় ভিসা অ্যাপ্লিকেশন সেন্টারে। ভুটান যাবার টিমের ৪২ জনের ভিসা হয়ে হয়ে গেছে বিভিন্ন সময়ে। সপ্তাহ খানেক আগে ভিসা পাওয়া বউ অপেক্ষায় বসে আছে বাসায়। কেবল অভাজন এই সাংবাদিকের ভিসা হয়নি। পাসপোর্ট ডেলিভারি কাউন্টার থেকে জানানো হলো, আপনার পাসপোর্ট আসেনি। বউকে বলে এসেছি, আমার কাপড় আলাদা রাখতে। যেন ভিসা না পেলে তিনি টিমের সঙ্গে চলে যেতে পারেন। আমাকে ফেলে যেতে রাজী হচ্ছেন না তিনি।
আমরা ভূটান যাচ্ছি কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কয়েকজন সদস্যের ব্যক্তিগত উদ্যোগে। এই ভ্রমণটি সাংগঠনিক নয়। তবে ভ্রমণকারীরা সবাই অভিন্ন মতাদর্শের মানুষ। এজন্য এই যাত্রাটি কোনভাবেই হাতছাড়া করতে চাই না। ভিসা সেন্টারের কাঁচের রুমে একজন বসে আছে। অস্থিরতা নিয়ে তার রুমে ঢুকলাম। বলা হলো, আজই সন্ধ্যায় যাত্রার ডেট। পাসপোর্ট এখনো হাতে পাওয়া গেল না। তিনি টোকেন নিয়ে ল্যাপটপে খোঁজ করলেন। তারপর নিজের মোবাইলে অনুসন্ধান চালালেন। বললেন, অপেক্ষা করেন। অপেক্ষায় থাকলাম অনেকক্ষণ। তখন ঘড়িতে সাড়ে চারটা বাজে। ফোনের পর ফোন আসছে। সবাই জানতে চাইছে ভিসা হলো কিনা। আবার সেই কাঁচের রুমে খোঁজ। তিনি বললেন, পাসপোর্ট আসছে, অপেক্ষা করুন। আবার অপেক্ষা। সাড়ে পাঁচটা বাজে। ক্রমশ: অস্থির হয়ে উঠছি। আরও কয়েকজন অপেক্ষায় আছে। ছয়টার সময় ভিসা সেন্টারের সবাই একে একে চলে যাচ্ছে। এমনকি আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন যে কর্মকর্তা তিনিও চলে গেলেন। পুরোপুরি হতাশ হয়ে পড়ছি। সাতটার দিকে খবর পাওয়া গেল ভুটান যাত্রীরা সবাই কমলাপুর বাস স্টপেজে এসে গেছেন। অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, ভারতে বেড়াতে গিয়ে আর কোন দিন রিপোর্ট করবো না। পক্ষেও না। বিপক্ষে লেখার তো প্রশ্নই ওঠে না। সাড়ে ৭টায় কমলাপুর থেকে ভুটান যাবার বাস ছেড়ে দিলো। হতাশা নিয়ে বসে আছি। সন্ধ্যা ৭টা ৩৫মিনিটে খবর পাওয়া গেল, পাসপোর্ট আসছে। রবিবার যাদের ডেলিভারি দেওয়া হবে সেই পাসপোর্ট আসছে। সঙ্গে কিছু জরুরি পাসপোর্ট থাকতে পারে।
শেষ দেখে যেতে চাই। কারণ, যে বাসে আমাদের যাত্রা সেটার সব যাত্রীই আমরা। ভিসা পেলে বাস লেট করানো যাবে। কল্যানপুর থেকে উঠতে চাইলে হাতে দেড় ঘন্টা সময় পাওয়া যাবে। ন’টায় গেলেও হবে। সন্ধ্যা ৭.৪০মিনিটে শোনা গেল পাসপোর্ট এসেছে। আমাদের উত্তেজনা বাড়ছে। ভারতীয় দূতাবাসের কর্মীরা জানালেন, গোছাতে একটু সময় লাগবে। অপেক্ষা করেন। শেষ পর্যন্ত রাত আটটায় গরম গরম ভিসাসহ পাসপোর্ট হাতে পাওয়া। সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজনকে জানালাম। বউকে বলা হলো, ভিসা পেয়ে গেছি। তিনি যেন আনন্দে নাচতে লাগলেন। ভারতীয় ভিসা সেন্টার থেকে উত্তরার বাসায় পৌঁছে দেখি দুয়ারে গাড়ি প্রস্তুত। সেখান থেকে রাত ন’টার পর কল্যানপুর গিয়ে সবার সঙ্গে বাসে উঠলাম।
লালমনিরহাটের বুড়িমারি স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে ঢুকতে হয়। ওপারে ভারতের চ্যাঙ্গড়াবান্দা। সকাল ন’টায় বাস পৌঁছায় বুড়িমারিতে। শুক্রবারে স্থানীয় ব্যাংক বন্ধ। ঈদের ছুটিতে প্রায় হাজার মানুষের ভিড়। ট্রাভেল ট্যাক্স দিতে হয় ২০ কিলোমিটার দূরের পাটগ্রামে একটি ব্যাংকের শাখায়। সেই কাজ সারতে সারতে দুপুর গড়িয়ে বিকাল। গাড়ির সিরিয়াল ধরে ধাক্কাধাক্কি করে ইমিগ্রেশনের কাজ সারতে হলো। শেষ পর্যন্ত বর্ডার পেরিয়ে ভারতে ঢুকতে ঢুকতে বিকাল পাঁচটা। ভারতের কাস্টমস ও ইমিগ্রেশনের কাজ সেরে অপেক্ষমান কোস্টারে উঠলাম সন্ধ্যা ছয়টায়। ভুটানের বর্ডারে পৌছাতে লাগলো তিন ঘন্টা।
চ্যাঙ্গরাবান্ধায় গিয়ে পাওয়া গেল মনোজ কুমার কানুকে। তিনি শ্যামলীর যাত্রীদের পাসপোর্ট পরিষেবার কাজ করেন অনেক বছর ধরে। ইদানীং একটি মানি এক্সচেঞ্জ এর এজেন্সীও দিয়েছেন। ২০১৩ সালের এক শীতের রাতে বর্ডার পার করে দিয়েছিলেন ধান ক্ষেত দিয়ে। সেই দিনের ঘটনা মনে করিয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। একসঙ্গে ছবিও তুললাম। একমাত্র সন্তান ছেলে মুশফিক মাহমুদ তখন পড়তো দার্জিলিংয়ের একটি স্কুলে। এজন্য আমাকে বছরে একাধিকবার সেখানে যেতে হতো। সেদিন বর্ডার ক্লোজ করার একঘন্টা পর মনোজের সহায়তায় দেশে ফিরতে পেরেছিলাম। মনোজ বললেন, ভুলেই গেছিলাম, আসলেই সেটি ছিল বড় ঘটনা।
সন্ধ্যার সামান্য আগে আমাদের কোস্টার ছাড়লো ভারতের চ্যাঙ্গড়াবান্ধা বর্ডার থেকে। ভেবেছিলাম দিনের আলোয় ভারতের বিভিন্ন এলাকা দেখতে দেখতে ভুটান গিয়ে পৌঁছাবো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভুটান পৌছালাম রাত সাড়ে ১০টায়। বৃষ্টি পড়ছিলো গুঁড়ি গুঁড়ি। আমি শেষ দিকে ঝিমাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম জয়গাঁওয়ে রাতে হেটেলবাস করতে হবে। সেটা ভেবেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। বিষ্যুদবার বিকালে ঘর থেকে বেরিয়েছি। শুক্রবার রাতে ভারতের ভূখন্ড পেরোচ্ছি। শনিবার সকালে যদি ভুটান ঢুকি তাহলে তিনদিন তো রাস্তায়ই কেটে যাচ্ছে। আমি রাস্তার পাশের সাইনবোর্ড দেখছিলাম। অনেকক্ষণ দেখছি, জয়গাঁও, কোচবিহার। হঠাৎ দেখলাম ছিমছাম সাজানো গোছানো এক নতুন জায়গা। ভবনের প্যাটার্ন আলাদা। মাথার উপড়ে পাহাড়। আমি নড়ে চড়ে বসলাম। কে যেন একজন বললেন, আমরা ভুটান পৌঁছে গেছি। সত্যিই আমরা রাত সাড়ে ১০টায় ভুটান পৌঁছে গেছি। দুটি হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। আমাদের টিম লিডারদের যোগাযোগ ছিল হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। নিজেরা থাকার জায়গা বুঝে পেয়েই অন্য হোটেলে খাবার জন্য গেলাম। হোটেলে রাতে ভাত খেলাম বুফে। দীর্ঘ বাস যাত্রার ক্লান্তি নিয়ে আগামী দিনের রোমাঞ্চকর ভ্রমনের স্বপ্নে ঘুমিয়ে পড়লাম।
২৫ আগস্ট বেশ ভোরেই ঘুম ভাঙলো। আমার শ^শুরের কন্যা সাদিয়া পারভীন বললেন, চলো শহরটা দেখে আসি। ভোরে ভুটানের সীমান্ত শহর ফুয়েন্টশোলিংয়ে হাঁটতে বেরিয়ে বেশ আনন্দই পেলাম। ভবনগুলো কেমন যেন আলাদা। মাথার উপরে বিশাল পাহাড়। আঁকাবাকা রাস্তায় লেন ধরে সুশৃঙ্খলভাবে যানবাহন চলছে। ময়লাবাহী অসংখ্য ট্রাক ত্রিপলে ঢেকে ময়লা অপসারণ করছে। এছাড়া সিলিন্ডারবাহী অনেক ট্রাক বাসাবাড়ি ও দোকান থেকে খালি সিলিন্ডার সংগ্রহ করছে এবং গ্যাসভর্তি সিলিন্ডার দিয়ে আসছে। শহরটির শৃঙ্খলা দেখে খুব ভালো লাগলো। সাড়ে আটটার দিকে হোটেল নামগেতে নাস্তা সেরে ভারতের জয়গাঁও গেলাম ইমিগ্রেশনের কাজ সারতে। ৪৩জন যাত্রীর ইমিগ্রেশনের কাজ সারতে ঘন্টা খানেক সময় লাগলো। সেখান থেকে আবার গেট পেরিয়ে ভুটানে ঢুকে ইমিগ্রেশন অফিসের সামনে দাঁড়াই। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জানালেন, বিদ্যুত নেই। বিকাল ৪টায় আসেন। তখন বিদ্যুত আসবে। আমাদের সবার মাথায় হাত। সারাদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে। ভুটান ভারতে বিদ্যুত রফতানি করে। অথচ ভুটানের ইমিগ্রেশন অফিসে ৬ঘন্টা বিদ্যুত থাকবে না। এটি কোন কথা হলো?
Leave a Reply