ইব্রাহিম মন্ডল, ঢাকা
রাজধানীতে দিন দিন বাড়ছে গাড়ির সংখ্যা। গাড়ির সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে জ্বালানি তেল ও লুব্রিকেন্টের চাহিদাও। এ চাহিদাকে পুঁজি করে এক শ্রেণীর অসাধু চক্র নকল-ভেজাল তেল, লুব্রিকেন্টের ব্যবসা করে ক্রেতাদের দিনের পর দিন ঠকিয়ে যাচ্ছে। এভাবে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকার নিম্নমানের ও পোড়া রিফাইনিং লুব্রিকেন্ট বিক্রি হচ্ছে। মোড়ক, বোতল ও কোম্পানি একই; কিন্তু এক দোকান থেকে অন্য দোকানে মবিল বা লুব্রিকেন্টের দাম বোতল বা ক্যানপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কম।
র্যাব সূত্রে জানা যায়, নিম্নমানের রিফাইনারি পুরনো মবিল বা লুব্রিকেন্ট সংমিশ্রণ করে এবং ভেজাল কেমিক্যাল মিশিয়ে বিভিন্ন দেশের নামী-দামী ব্র্যান্ড যেমন— Visco, Long run, Pe+, Climax, Super-V, Castrol ইত্যাদির নকল-ভেজাল মবিল বা লুব্রিকেন্ট তৈরি করে সারাদেশে বাজারজাত করা হচ্ছে। বিদেশী নামী-দামী ব্র্যান্ডের স্টিকার লাগিয়ে বাজারজাত করার উদ্দেশ্যে বিপুল পরিমাণ তেল, মবিল বা লুব্রিকেন্ট মজুত রাখাও হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এ সকল ভেজাল তেল, মবিল বা লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করে জনসাধারণ ও কৃষকরা প্রতারণার শিকার হচ্ছেন। বাজারের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মবিল বা লুব্রিকেন্ট ভেজাল ও নিম্নমানের উপাদান দিয়ে তৈরি।
সম্প্রতি পুরনো ঢাকার চকবাজার সোয়ারী-ঘাট এলাকায় চম্পাতলী লেনে র্যাব-১০ অভিযান চালিয়ে নকল-ভেজাল মবিল বা লুব্রিকেন্ট বিক্রি করে এমন ৫টি প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেয়। ওই প্রতিষ্ঠানগুলো ভেজাল ও নকল মবিল বা লুব্রিকেন্ট উৎপাদন ও বিক্রি করছিল। এরমধ্যে ‘প্রভাতি এন্টারপ্রাইজ’-এর মালিক মো. আজিজুর রহমানকে ৬ লাখ টাকা, ‘মধুমতি ট্রেডার্স’-এর মালিক মো. মনিরুজ্জামানকে ২ লাখ টাকা ও ‘তালুকদার এন্টারপ্রাইজ’-এর মালিক মো. জসীম উদ্দীনকে ১ লাখ টাকা, জরিমানা করা হয়। ‘খান এন্টারপ্রাইজ’ ও ‘রফিক এন্টারপ্রাইজ’-এর মালিক ও ম্যানেজার পলাতক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পুরান ঢাকার চাঁনখারপুল, খাজে দেওয়ান, নিমতলী, চকবাজার, লালবাগ, ইসলামপুর, তাঁতীবাজার, ধোলাইখালসহ রাজধানীর কারওয়ান বাজার এলাকায় এই অবৈধ কাজে জড়িত একাধিক সিন্ডিকেট রয়েছে।
এদিকে ভেজাল তেল বা ভেজাল লুব্রিকেন্ট তৈরির কারখানাগুলোতে পোড়া লুব্রিকেন্টের ভেতর এক ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর কারণে তা আগের রং ফিরে পায়। এরপর ভাল লুব্রিকেন্ট বলে তা চালিয়ে দেওয়া হয়।
ঢাকায় প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকার নিম্নমানের ও পোড়া রিফাইনিং লুব্রিকেন্ট বিক্রি হচ্ছে। ফলে লোকসান গুনছে ভাল মানের লুব কোম্পানিগুলো; আর নষ্ট হচ্ছে ইঞ্জিন। তবুও কম দামের জন্য না বুঝেই ক্রেতাদের কাছে ওগুলোর চাহিদাই বেশি। মোটর সাইকেল গ্যারেজ, গাড়ির ওয়ার্কশপ, মোটরসাইকেল পার্টসের দোকান, পেট্রোলিয়ামের দোকান, মুদির দোকান, হার্ডওয়্যারের দোকানে বিক্রি হচ্ছে ওই তেল, লুব্রিকেন্ট।
র্যাব সদর দফতরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম এ বিষয়ে বলেন, ‘বাজারে এ সমস্ত নকল লুব্রিকেন্টের অনেক বেশি চাহিদা রয়েছে। কারণ গাড়িচালকরা মালিকের কাছ থেকে আসলের দাম নিয়ে নকল মবিল কিনছে। চাহিদার কারণে বাজারের প্রায় ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ মবিল বা লুব্রিকেন্ট ভেজাল ও নিম্নমানের। ভেজাল লুব্রিকেন্ট ব্যবহারের ফলে গাড়ির ইঞ্জিন অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিকল হয়ে যায়। গাড়ি দুর্ঘটনাকবলিত হয় এবং জান-মালের মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।’
গত বছর রাজধানীর নবাবপুরে মদন পাল লেন এলাকার মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে বিদেশী নামী-দামী ব্র্যান্ডের ভেজাল ও নকল লুব্রিকেটিং অয়েল ও ব্রেক অয়েলের ২ হাজার ৮৬২টি ক্যান জব্দ করা হয়।
র্যাব-১০ এর অভিযানে দেখা যায়, মেসার্স শামীম ট্রেডার্স, খান ট্রেডার্স ও মোহাম্মদী ট্রেডার্স দোকানে দীর্ঘদিন ধরে কেরোসিন, ডিজেল ও নিম্নমানের রিফাইনারি পুরান লুব্রিকেন্ট সংমিশ্রণ করে ও ভেজাল কেমিক্যাল মিশিয়ে বিভিন্ন দেশের নামী-দামী ব্র্যান্ডের নামে চালানো হচ্ছে।
মেসার্স শামীম ট্রেডার্সের ম্যানেজার এবং মালিকের খালাতো ভাই (সহকারী ম্যানেজার) ও তিনজন কর্মচারীকে নকল লুব্রিকেন্ট তৈরি ও বিক্রি করার সময় হাতেনাতে আটক করা হয়। এ ধরনের নকল ও ভেজাল লুব্রিকেন্ট অয়েল তৈরির অপরাধে জড়িত থাকার কারণে শামীম ট্রেডার্সের ম্যানেজারকে ১ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা এবং সহকারী ম্যানেজারকে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। মোহাম্মদী ট্রেডার্স ও খান ট্রেডার্সের মালিক ও ম্যানেজার পলাতক থাকায় নিয়মিত মামলা দায়েরের আদেশ দেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। ওই তিনটি প্রতিষ্ঠানকে সিলগালা করা হয়। নকল ও ভেজাল লুব্রিকেন্ট অয়েলের ক্যানগুলো মাতুয়াইলের দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ডাম্পিং স্টেশনে ধ্বংস করা হয়।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, নষ্ট ও পুরনো কালো হয়ে যাওয়া পোড়া মবিল বা অন্যান্য লুব্রিকেন্ট প্রতিলিটার ২০ থেকে ২৫ টাকা দরে কিনে অসাধু ব্যবসায়ীরা। লুকিয়ে পোড়া মবিল বা লুব্রিকেন্টে কেমিক্যাল দিয়ে রিফাইন করা হয়। পরে আকর্ষণীয় আসল ব্র্যান্ডের প্লাস্টিকের বোতলে আরবী ও ইংরেজী ভাষায় লেখা এক নম্বর খাঁটি লুব্রিকেন্ট বলে বিক্রি করা হয়। চালকরা এ ধরনের মবিল বা লুব্রিকেন্ট গাড়ি, মোটরসাইকেল, ট্রাক্টর, ট্রলারসহ বিভিন্ন ইঞ্জিনে ব্যবহার করার ফলে কিছুদিনের মধ্যে ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দেয়।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম আরও বলেন, ‘দেশে ভেজাল তেল, লুব্রিকেন্ট তৈরি ও বাজারজাতের একটি অবৈধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এই ভেজাল ও নকল তেল, মবিল বা লুব্রিকেন্টের ক্যানের আকার আকৃতি ও লেভেলিং দেখতে হুবহু আসল ক্যানের মতো। সাধারণ ক্রেতাদের বুঝার কোনো উপায়ই থাকে না যে, এটি দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা, না কি দেশীয় নকল পণ্য। এ সব ক্যান আসল ক্যানের চেয়ে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা কম হওয়ায় সাধারণ খুচরা ব্যবসায়ীরা এ ধরনের নকল মবিল বা লুব্রিকেন্ট কিনে তা সাধারণ ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতে বেশি আগ্রহী হন।’‘তৈরি ও সরবরাহ করা ভেজাল তেল, লুব্রিকেন্ট কৃষি কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন মেশিনারি ইঞ্জিনে (পাওয়ার টিলার, শ্যালো মেশিন ইত্যাদি) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এর ফলে কৃষি কাজে ব্যবহৃত মেশিনারি ইঞ্জিন অতি দ্রুত বিকল হয়ে যায়। এতে সাধারণ কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন’ বলেও যোগ করেন তিনি।
Leave a Reply