সড়ক-মহাসড়ক উন্নয়নের অন্যতম উপাদান বিটুমিন বর্তমানে দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে সরকার বিটুমিনের ক্ষেত্রে আমদানিনির্ভর। এই আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশে উৎপাদিত বিটুমিন ব্যবহারের নীতি গুরুত্বসহকারে বাস্তবায়ন করা জরুরি। তাতে সময় ও অর্থ দুই-ই সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া আমদানি করা বিটুমিন নিম্নমানের। এই নিম্নমানের বিটুমিনের কারণে দেশের বেশির ভাগ সড়ক নষ্ট হচ্ছে।
দেশে বিটুমিনের চাহিদার এক-দশমাংশ উৎপাদন করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসির মালিকানাধীন ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। বাকি বিটুমিন আমদানি করে চাহিদা মেটানো হয়। বিটুমিনের দুটি গ্রেড আছে। তবে উচ্চমানের ‘৬০-৭০’ গ্রেডের বিটুমিন নিয়ে চলছে লুকোচুরি। বিটুমিন উৎপাদন ও বিপণনে অনৈতিক লেনদেনের অভিযোগও বিস্তর।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার প্রকৌশলী বিভাগ-এলজিইডি বেশির ভাগ বিটুমিন ব্যবহার করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে ছয় লাখ টনের বেশি বিটুমিন প্রয়োজন। এর মধ্যে ইস্টার্ন রিফাইনারি উৎপাদন করে ৬০ থেকে ৭০ হাজার মেট্রিক টন। এলজিইডি পুরো বছরের জন্য এক লাখ ৮৪ হাজার টন বিটুমিনের চাহিদা দিয়ে পত্র দেয় বিপিসিকে। জানুয়ারির মাসওয়ারি চাহিদাপত্রে তিন মাস আগের চাহিদা উল্লেখ করা হয়। এ নিয়ে রয়েছে বিতর্ক।
ইস্টার্ন রিফাইনারি বলছে, উৎপাদনের পর বিটুমিন ছয়-সাত দিন পর্যন্ত মজুদ করা যায়। আর সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর বলছে বারবার গরম ও ঠাণ্ডা করলে বিটুমিনের মান নষ্ট হয়।
বিপিসি সূত্র জানায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৯ হাজার ৮৭৭ মেট্রিক টন বিটুমিন উৎপাদন করে ইস্টার্ন রিফাইনারি। ৬৬ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন বিটুমিন বিক্রি করে বিপিসি। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিপিসির বিক্রির চাহিদা ৬০ হাজার মেট্রিক টন। গত ১ মার্চ ইস্টার্ন রিফাইনারিসহ চার বিতরণ কম্পানিতে সব মিলিয়ে বিটুমিনের মজুদ ছিল ১২ হাজার ৭৪৩ টন। গত ১ জানুয়ারি মজুদ ছিল ১১ হাজার ৩৬৬ টন বিটুমিন। এর মধ্যে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে দুই হাজার ৮১৩ টন, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কম্পানিতে ২৩৬ টন, পদ্মা অয়েল কম্পানিতে তিন হাজার ৩৮৯ টন, যমুনা অয়েল কম্পানিতে তিন হাজার ২৪৫ টন ও মেঘনা পেট্রোলিয়ামে মজুদ ছিল তিন হাজার ৬০ টন বিটুমিন।
বিপিসির বিতরণ কম্পানিগুলোয় বিটুমিনের মজুদ বেড়ে যাওয়ায় গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিটুমিনের দাম কমিয়েছে বিপিসি। ১৫০ কেজির প্রতি ড্রামে ৫০০ টাকা ও বাল্কে প্রতি টনে তিন হাজার ৩০০ টাকা দাম কমায় বিপিসি। বর্তমানে ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ড্রামপ্রতি আট হাজার ৫০০ টাকা, ৬০-৭০ গ্রেডের দাম আট হাজার ৯০০ টাকা।
সওজ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পের ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন দরকার। কিন্তু ইষ্টার্ন রিফাইনারির মাধ্যমে তা পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে যে গ্রেডের বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে তা সরবরাহ না করা হলে চলবে না। বর্তমানে সড়ক ও জনপথ রাস্তা নির্মাণে ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন ব্যবহার করে না। আমদানি করা বিটুমিনের চেয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিনের মান অনেক উন্নত। যে কারণে প্রাইভেট কম্পানির বিটুমিন আমরা ঠিকাদারদের কনসিডার করি না।
জানা যায়, গত ১৫ জানুয়ারি এক লাখ ৮৪ হাজার টন বিটুমিনের চাহিদা উল্লেখ করে বিপিসিকে চিঠি দেয় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। এলজিইডির প্রধান প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) সুশংকর চন্দ্র আচার্য্য স্বাক্ষরিত ওই পত্রে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত তিন মাসের চাহিদা উল্লেখ করা নিয়েও সমালোচনা তৈরি হয়েছে। চাহিদার পুরোটাই ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদন বা আমদানির অনুরোধ করা হয়।
এলজিইডির প্রকৌশলীরা জানান, ৮০-১০০ ও ৬০-৭০ গ্রেড দুটোই ব্যবহার করা হয় স্থানীয় সরকার বিভাগের রাস্তা উন্নয়ন কাজে। দেশের অবকাঠামো নির্মাণে ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিনও অনেক ভালো।
জানা গেছে, বেসরকারি আমদানিকারকরা বিপিসির লোকজনকে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে আসছেন। তাতে তাঁরা অপ্রয়োজনীয় বিটুমিন তৈরি করেন। ৮০-১০০ গ্রেডের বিটুমিন এখন কেউ ব্যবহার করে না। ৬০-৭০ গ্রেডের বিটুমিন প্রাইভেট আমদানিকারকরা বাল্কে নিয়ে আসেন। তা গরম করে ট্যাংকে নেন। বিক্রির সময় আরেক দফা গরম করেন। এভাবে বারবার গরম ও ঠাণ্ডা করায় বিটুমিনের মান নষ্ট হয়।
ইস্টার্ন রিফাইনারি ও বিপিসির কর্মকর্তারা দাবি করেন, দেশে বিটুমিনের মূল ব্যবহারকারী এলজিইডি এবং সড়ক ও জনপথ। তাদের প্রকৌশলী ও কর্মকর্তারা অনৈতিক সুবিধা নিয়ে প্রাইভেট কম্পানি থেকে বিটুমিন নিয়ে থাকেন। ইস্টার্ন রিফাইনারিতে উৎপাদিত বিটুমিন উচ্চমানসম্পন্ন। ইস্টার্ন রিফাইনারির বিটুমিন ব্যবহার করলে সড়ক নষ্ট হওয়ার কথা নয়।
Leave a Reply