সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মহামারি ঠেকাতে আমাদের কার্যকর উদ্যোগ ও তৎপরতা এখনো অনেক কম। বড় কোনো দুর্ঘটনার পর বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনা হয়। পরে সেটা আর ¯’ায়ী হয় না। দুর্ঘটনার নেপথ্য অনুষঙ্গগুলো খতিয়ে দেখা হয় না। প্রতিকারে নেয়া হয় না কার্যকর কোনো ব্যব¯’া। আলোচনার গভীরে যাওয়ার আগে দুর্ঘটনায় মৃত্যুকে মহামারি আখ্যা দেওয়ার ব্যাখ্যাটা একটু দিয়ে নেই। কিছুদিন আগে দেশজুড়ে ডেঙ্গু আতঙ্ক এবং এডিস মশার উপদ্রবে রাষ্ট্রীয় তৎপরতা, বেসরকারি উদ্যোগ, কয়েল, মশারি, টেস্ট, পরীক্ষায় আমরা যে পরিমাণ খরচ ও হূল¯’’ূল করেছি তাতে পুরো জাতির মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রায় তিন মাসের ডেঙ্গু তান্ডবে সারা দেশে কতজন মারা গেছেন? সর্বসাকুল্যে ১৪৫ জন। প্রতিটি অকাল মৃত্যুই বেদনার, অপূরনীয় ক্ষতির। কিš‘ু সড়ক দুর্ঘটনায় কতজন মারা যা”েছন? গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলে, সড়ক দুর্ঘটনায় দিনে অন্তত: ১৫ জনের মৃত্যু হ”েছ। এটা কি মহামারির চেয়ে কম কিছু? অথচ এই নিত্য দুর্ঘটনা ও মৃত্যুর মহামারির দিকে যেভাবে সার্বক্ষনিক নজরদারি, কঠোর ও মানবিক পদক্ষেপ দরকার ছিল সেটা হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় মেধাবী ও কর্মক্ষম জনসম্পদ হারিয়ে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হ”েছ। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে সঠিক সমন্বিত কর্মসূচি নেয়া হলে সড়ক দুর্ঘটনা ৯০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব।
আমরা জানি, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে অনেকগুলো কার্যকারণ সম্পর্কিত। তারমধ্যে ড্রাইভার একটি বড় ফ্যাক্টর। আছে সড়ক পরিবেশ, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, যাত্রী-পথচারিদের বেপরোয়া চলাচলসহ বিভিন্ন কারণ। আমাদের দেশের সড়ক পরিবেশ দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি সহায়ক। নতুন একটি সড়ক হলে সেই সড়কের দু’পাশে সবার আগে বাজার, দোকানপাট বসে যায়। নতুন সড়কের পাশে ঘরবাড়ি তুলে আবাসিক এলাকা বানিয়ে ফেলা হয়। সড়কের পাশের জায়গা-জমি মহামূল্যবান হয়ে যায়। আঞ্চলিক সড়কগুলোতে মানুষ ধান শুকায়। দৌঁড়ে রাস্তা পার হয়। বিদ্যমান মহাসড়কগুলোর অব¯’া খুবই নাজুক। হাজার হাজার কোটি ব্যয়ে যেসব মহাসড়ক চারলেন করা হয়েছে সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ চিত্র খুবই খারাপ। যেন দেখার কেউ নেই। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বাড়ি নোয়খালি। তার নিয়মিত ব্যবহারের পথ হ”েছ ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে। সেটার অব¯’া কেমন? সেই মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে রিক্সা, ভ্যান, ব্যাটারিচালিত থ্রিহুইলার দাপিয়ে বেড়ায়। সেগুলো আবার উল্টোপথে চলাচল করে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ২০১৭ সালে মহাসড়কে বিপজ্জনক থ্রিহুইলার, নসিমন, করিমন বন্ধের যে নির্দেশ দিয়েছিলেন তার কতটুকু পালন হলো? কেউ কি মানছে সেই নির্দেশনা। মানার জন্য কি কোন উদ্যোগ, তৎপরতা আছে। নেই। কারণ, ¯’ানীয় পুলিশ কাজ করে না। সরকারি নির্দেশ পালন করে না। হাইওয়ে পুলিশের বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই। আর সবচেয়ে হতাশার বিষয়, নির্দেশ দাতারা ফলোআপ করে না। ফলে, কার্যকর তদারকির অভাবে মহাসড়কগুলো আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। সড়ক দুর্ঘটনার অধিকাংশ ক্ষেত্রে মহাসড়কে চলাচলকারী থ্রিহুইলার জড়িত। অন্যদিকে যাত্রী-পথচারির বেপরোয়া চলাচলও কম দায়ী নয়। চলন্ত গাড়ির সামনে দিয়ে রাস্তা পারাপারের সংস্কৃতি কবে বন্ধ হবে কেউ জানে না।
সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ড্রাইভারদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। দুর্ঘটনা রোধেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সড়ক পরিবেশের পাশাপাশি ড্রাইভাররা সচেতন হলে দুর্ঘটনা নিশ্চিত অনেক কমে যাবে। একজন ড্রাইভারকেই ধরে নিতে হবে সড়ক নিরাপত্তার মূল নায়ক। যানবাহন ড্রাইভিং অত্যন্ত টেকনিক্যাল কাজ। গাড়ি চালনার সময় চালকের চোখ, কান, মাথা (ব্রেন), হাত, পাসহ পুরো অস্তিত্ব জড়িত থাকে। তাই নিরাপদ ড্রাইভিংয়ের জন্য শিক্ষিত, মেধাবী, সচেতন মানুষের ড্রাইভিং পেশায় আসা উচিত। মহাসড়কে চলাচলকারী ভারী যানবাহন চালকদের কমপক্ষে এসএসসি পাশ হওয়া দরকার। যারা মনে করেন, অষ্টম শ্রেণী পাশেরও দরকার নেই, শুধু গরু ছাগল চিনলেই হলো, তারা দলভারী করার জন্য এসব বলেন। একজন শিক্ষিত ড্রাইভারই জানবেন ৩০-৫০টন পণ্য নিয়ে মহাসড়কে একটি গাড়িকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। পরিবহন মালিকরা বিনিয়োগকারী হিসাবে কোটি টাকা দামের গাড়ি কোন ভরসায় একজন অল্প শিক্ষিত ড্রাইভারের হাতে ছেড়ে দেবেন। তবে ড্রাইভিং পেশায় শিক্ষিত তরুনদের নিয়ে আসতে হলে ভালো বেতন-ভাতার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। অন্যদিকে যারা এখন ভালো গাড়ি চালা”েছন কিš‘ লেখাপড়া হয়ে উঠেনি, শেষ সুযোগ হিসাবে বিশেষ বিবেচনায় তাদেরও ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে। যারা হেভি লাইসেন্স পাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় আছেন তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেটি দিতে হবে। মোট কথা বাণিজ্যিক যানবাহনের যেসব লাইসেন্স এখনো ইস্যু করার বাকি আছে সেগুলো যতো দ্রুত সম্ভব ইস্যু করা দরকার। পরবর্তীতে যাতে শিক্ষিত তরুনরা ড্রাইভিং পেশায় আসতে পারে সে ব্যব¯’া নিতে হবে।
যে কারণে এই লেখা শুরু করেছিলাম এবার সেই প্রসঙ্গে আসি। সরকারের উদ্যোগে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নিম্নতম মজুরি বোর্ড ব্যক্তি মালিকানাধীন সড়ক পরিবহন সেক্টরে নিযুক্ত সকল শ্রেণির শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি হারের খসড়া সুপারিশের গেজেট প্রকাশ করেছে। প্রয়োজনীয় আপত্তি ও সুপারিশ বিবেচনার পর এটি চূড়ান্ত করা হবে। এতে বলা হয়, পরিবহন খাতের মালিক ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সদস্যদের দাখিল করা মজুরি প্রস্তাবসহ শ্রমিকদের জীবনযাপন ব্যয়, জীবনযাপনের মান, উৎপাদন খরচ, উৎপাদনশীলতা, উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য, মুদ্রাস্ফীতি, কাজের ধরন, ঝুঁকি ও মান, ব্যবসায়িক সামর্থ্য, দেশের এবং সংশ্লিষ্ট এলাকার আর্থ-সামাজিক অব¯’া এবং অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয় পর্যালোচনা করে খসড়া সুপারিশ পেশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, উ”চতর দক্ষ হিসাবে বিভাগীয় শহর ও আশেপাশের এলাকার ভারী যানবাহনের ড্রাইভারদের (পিএমভি লাইসেন্সসহ) মোট বেতন হবে ২০ হাজার ২০০ টাকা। এর মধ্যে মূল বেতন ১২ হাজার ৮০০ টাকা। বাড়ি ভাড়া (মূল বেতনের ৫০%) ৬ হাজার ৪শ’ টাকা, চিকিৎসা ভাড়া ৭শ’ টাকা, যাতায়াত ভাতা ৩শ’ টাকা। অন্যান্য এলাকার জন্য মোট বেতন হবে ১৮ হাজার ৯২০ টাকা। এরমধ্যে মূল বেতন ১২ হাজার ৮০০ টাকা, বাড়ি ভাড়া (মূল বেতনের ৪০%) ৫ হাজার ১২০ টাকা। শুধু ভারী যানবাহনের লাইসেন্সপ্রাপ্ত ড্রাইভারদের বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট বেতন হবে ১৭ হাজার ৮শ’ টাকা। এরমধ্যে মূল বেতন ১১হাজার ২শ’ টাকা এবং বাড়ি ভাড়া (মূল বেতনের ৫০%) ৫ হাজার ৬শ’ টাকা। অন্যান্য এলাকায় মূল বেতন ১৬ হাজার ৬৮০ টাকা। এর মধ্যে মূল বেতন ১১হাজার ২শ’ টাকা এবং বাড়ি ভাড়া (মূল বেতনের ৪০%) ৪ হাজার ৪৮০ টাকা। মিডিয়াম লাইসেন্সপ্রাপ্ত দক্ষ-১ শ্রেণীর ড্রাইভারদের বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় মোট বেতন হবে ১৬ হাজার ৬শ’ টাকা। অন্যান্য এলাকায় মোট বেতন ১৫হাজার ৫৬০ টাকা। লাইট গাড়ির লাইসেন্সপ্রাপ্ত ড্রাইভারদের বিভাগীয় শহরে মোট বেতন হবে ১৫ হাজার ৪শ’ টাকা এবং অন্যান্য এলাকায় ১৪ হাজার ৪৪০ টাকা। দক্ষ-২ শ্রেণীর পরিবহন গাইড, সুপারভাইজার, কনডাক্টার, চেকার, বুকিং ক্লার্ক ও ক্যাশিয়ারের বেতন হবে বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় ১৩ হাজার টাকা। অন্যান্য এলাকায় ১২ হাজার ২শ’ টাকা। অদক্ষ শ্রেণীর হেলপার, ক্লিনার, কলারদের বেতন হবে বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশন এলাকায় ১০ হাজার ৭৫০ টাকা ও অন্যান্য এলাকায় ১০ হাজার ১০০ টাকা। এসব বেতনের প্রতিটির ক্ষেত্রে মূল বেতন, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ও যাতায়াত ভাতা উল্লেখ রয়েছে। শ্রমিকদের শিক্ষানবিস কাল তিন মাস। কাজে সš‘ুষ্ট না হলে এটি বাড়ানোও যাবে। শিক্ষানবিসকালে শ্রমিকরা বেতন পাবেন সর্বসাকুল্যে সাড়ে ৭ হাজার টাকা। শিক্ষানবিসকাল সন্তোষজনকভাবে শেষ হলে শ্রমিক সংশ্লিষ্ট গ্রেডের ¯’ায়ী শ্রমিক হিসাবে নিযুক্ত হবেন।
নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতের পূর্বশর্ত হলো, যানবাহনের মূল চালিকাশক্তি ড্রাইভার ও অন্য শ্রমিকদের জীবিকার নিশ্চয়তা দেওয়া। ড্রাইভাররা যদি আর্থিক ও মানসিকভাবে ভালো থাকে, স্ব¯ি’ ও শান্তিতে থাকে তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায়। অশান্ত বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে, মাথায় হাজারো দু:শ্চিন্তা নিয়ে ড্রাইভিংয়ের মতো একটি টেকনিক্যাল কাজে দুর্ঘটনামুক্ত থাকা কঠিন। একটি দুর্ঘটনা আসলে কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। পরিবহন শ্রমিকরা যদি দিনশেষে ভালো থাকে তাহলে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নের পথ অনেক এগিয়ে যায়। সরকার পরিবহন শ্রমিকদের নিন্মতম মজুরি নির্ধারনের যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি এক কথায় যুগান্তকারী বলে আমরা মনে করছি। কারণ, স্বাধীনতার ৪৮তম বছরে এসেও পরিবহন শ্রমিকরা ছিল স্বীকৃতিহীন। তাদের বেশির ভাগেরই কোন নিয়োগপত্র নেই। নির্ধারিত বেতন ভাতা নেই। সরকারিভাবে মজুরি নির্ধারণ কার্যকর হলে শ্রমিকরা নিশ্চিত নিয়োগপত্র পাবেন। একটা স্বীকৃতি পাবেন। এক্ষেত্রে মালিকদের অনেক কথা থাকতে পারে। নির্ধারিত বেতন দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সমস্যা থাকতে পারে। শ্রমিকরাও বলতে পারেন, প্রচলিত বাজারমূল্য অনুযায়ী প্রস্তাবিত বেতন-ভাতা কম। তবুও আমরা বলতে চাই, পরিবহন শ্রমিকদের নির্ধারিত বেতন থাকতে হবে, যাতে তারা নিশ্চিন্তে ড্রাইভিংটা করতে পারেন। ঘোষিত এই বেতন ভাতার চেয়েও বেশি হয়তো এখনও কোন কোন মালিক দি”েছন। সেটা অব্যাহত রাখতে হবে। একজন ড্রাইভার আপনার কোটি টাকা দামের গাড়ি পাহারা দি”েছন। এমনকি তিনি মালিকেরও নিরাপত্তারও অংশীদার। লাখ লাখ প্রাইভেট কার চালক তো গাড়ির মালিক কিংবা তার পরিবারের সদস্যদেরও নিরাপত্তার সঙ্গী। ড্রাইভিং করতে গিয়ে ঘটনাচক্রে পড়ে মালিকের সঙ্গে ড্রাইভারেরও জীবন গেছে-এমন দৃষ্টান্ত তো সমাজে কম নেই। তাই নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে ড্রাইভারদের ভালো থাকার ব্যব¯’া করতে হবে। তাদের বেতন ভাড়া ও চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে। নইলে নিরাপদ সড়ক চাই বলে সড়কে যতই কান্নাকাটি করা হোক-কোনো সুফল আসবে না।
লেখক : সাংবাদিক। ইমেইল : paribahanjagot@gmail.com|
Leave a Reply