করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতির মুখে পড়া দেশের পর্যটন খাত স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিগগিরই চালু করার বিষয়ে চিন্তা করছে সরকার।
পর্যটন খাত চালুর বিষয়ে প্রণীত একটি কার্যপ্রণালী সরকারের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যেই ঈদের পর সীমিত পরিসরে কক্সবাজারের পর্যটন কেন্দ্রগুলো খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে জেলা প্রশাসন।
তবে অনিয়ন্ত্রিত মহামারী পরিস্থিতির মধ্যে আতঙ্কিত মানুষ পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে আদৌ আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে পর্যটন ব্যবসায়ীরা বলছেন, ধসে পড়া এই খাত পুনরুদ্ধারে সবার আগে দরকার আর্থিক সহায়তা।
৩০ জুন প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের ‘কোভিড-১৯ ও দক্ষিণ এশিয়ায় পর্যটন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, মহামারীতে পর্যটন খাতের ক্ষতির কারণে জিডিপি থেকে ২০৩ কোটি ডলার (প্রায় সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা) হারাতে পারে বাংলাদেশ। এর ফলে সরাসরি ৪ লাখ ২০ হাজার কর্মসংস্থান ও খাতের সঙ্গে জড়িত প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের জীবিকা ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
দেশে পর্যটনের ক্ষতি ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা : টোয়াব
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ও প্রধান পর্যটন আকর্ষণ কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ও দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। মহামারীর কারণে চার মাস ধরে এই দুটি পর্যটন কেন্দ্র ব্ন্ধ রয়েছে।
এর ফলে শত শত হোটেল-মোটেল, দুই সহস্রাধিক খাবারের দোকান ও মার্কেটসহ পর্যটননির্ভর কয়েক হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। এতে প্রায় ৪০ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দেড় শতাধিক ট্যুর অপারেটরসহ দেড় লক্ষাধিক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল অ্যান্ড গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম শিকদার বলেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে ২৬ মার্চ সারাদেশে লকডাউন শুরু হলে কক্সবাজার পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ে। পরে লকডাউন শিথিল করা হলেও দেশের অন্যান্য এলাকার মতো কক্সবাজারও পর্যটকশূন্য রয়েছে।
দেশের পর্যটন খাতের মোট আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ আসে কক্সবাজার থেকে। একেবারে প্রপার কোনো হিসাব না থাকলেও আমাদের বিভিন্ন স্টাডি ও জরিপে বলা যায়, কক্সবাজার থেকে বছরে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা টার্নওভার হয়।”
মৌলভীবাজারের গ্র্যান্ড সুলতানের মতে বড় হোটেলগুলো রয়েছে অতিথিশূন্যতায়।মৌলভীবাজারের গ্র্যান্ড সুলতানের মতে বড় হোটেলগুলো রয়েছে অতিথিশূন্যতায়। পর্যটনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিন থেকে পাঁচ তারকা মানের দেশের ৪৫টি হোটেল মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের দাবি, করোনাভাইরাসের কারণে এই হোটেলগুলো এখন পর্যন্ত আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই সমিতির সচিব মোহসিন হক হিমেল বলেন, কক্সবাজারে কোনো পর্যটক নাই। তাদের হোটেলগুলো সব খালি। ডিসি অফিস থেকে খুব কড়াকড়ি থাকার কারণে পর্যটনের সবকিছু বন্ধ রয়েছে, পর্যটকরাও যাচ্ছে না। বেশির ভাগ হোটেলের অতিথি সংখ্যা ২ থেকে ৩ শতাংশে নেমে এসেছে, যা স্মরণকালে সর্বনিম্ন। অনেক হোটেল বন্ধ হয়ে গেছে।”
তবে ঈদের পর স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যটন খাত স্বাভাবিক করতে ডিসির সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানান তিনি।
এবিষয়ে জানতে চাইলে কক্সবাজারের ডেপুটি কমিশনার মো. কামাল হোসেন বলেন, “পর্যটন স্পটগুলো খুলে দেওয়ার বিষয়ে ঈদের পর পর আমাদের ডিসিপ্লিনারি কমিটির একটা মিটিং আছে। সেই মিটিংয়ের পরই সীমিত পরিসরে পর্যটন স্পটগুলো খুলে দেওয়ার পরিকল্পনা আছে।”
ওই বৈঠক থেকে কোন পর্যটন এলাকা কবে খুলে দেওয়া হবে সেবিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও তিনি জানান। দেশে ২০০টির মত রিসোর্ট রয়েছে, যেগুলোর অধিকাংশই গড়ে উঠেছে ঢাকার পাশের জেলা গাজীপুরে। গাজীপুরের জয়দেবপুরে ৫০ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ‘ছুটি’ রিসোর্ট।
এই রিসোর্টের মালিক মোস্তফা মাহমুদ আলী বলেন, মানুষ যদি বেড়াতে আসতে চায় তাহলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘুরে যেতে পারবেন, সেই প্রস্তুতি আমরা নিয়েছি। তবে রিসোর্টের ধারণক্ষমতার ১০ শতাংশ পর্যটক আসবে সন্দেহ আছে।
ময়মনসিংহের ভালুকার মেঘমাটি ভিলেজের মতো রিসোর্টগুলো এখন রয়েছে সঙ্কটেময়মনসিংহের ভালুকার মেঘমাটি ভিলেজের মতো রিসোর্টগুলো এখন রয়েছে সঙ্কটে
দেশের পর্যটন খাত চালুর বিষয়ে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রথমে পর্যটনের উপখাতগুলো চালুর লক্ষ্যে একটা ‘এসওপি (স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর) তৈরি হচ্ছে, যেখানে কীভাবে পর্যটন খাতকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে তা বলা থাকবে।
২৪ পৃষ্ঠার এসওপি প্রায় প্রস্তুত হয়েছে। দুয়েক দিনের মধ্যে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। সরকার তা অনুমোদন দিলে পর্যটনের উপখাতগুলো চালুর পদক্ষেপ নেব।”
তবে এর মধ্যে লকডাউন শিথিল করার পর কিছু রিসোর্ট চালু হলেও লোকজন আসছে না বলে ট্যুরিজম রিসোর্ট ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি খবির উদ্দিন জানান। তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ে যে পরিমাণ পর্যটক আসত, এখন সেই তুলনায় ১২ থেকে ১৫ শতাংশ হচ্ছে।
পর্যটন শিল্পকে দাঁড় করাতে সরকার যে পরিকল্পনাই নিক না কেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দ্রুত আর্থিক সহায়তা না দিলে কাজে আসবে না বলে মনে করেন ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়শন অব বাংলাদেশের সভাপতি মো. রাফিউজ্জামান। তিনি বলেন, “এসওপি করে সরকার কিছু নির্দেশনা দেবে কীভাবে পর্যটকদের গ্রহণ করা হবে। এর আগে তো দরকার আমাদের ব্যবসা চালু করা। সরকার যদি আর্থিক কোনো সহযোগিতা না করে তাহলে এই শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে।”
তার হিসেবে, কেবল বিমান পরিবহন খাত বাদে পর্যটনের সব খাত মিলে জানুয়ারি থেকে জুলাইয়ের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
রাফিউজ্জামান বলেন, “এই ক্ষতি পূরণ হবে না। এখানে লাখ লাখ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। সেই চিন্তা থেকে আমাদের খাতকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। এখন সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর তা নির্ভর করছে।”
সরকারের কাছে প্রণোদনা ও ঋণের সুযোগ পেতে বার বার দাবি জানালেও কোনো ব্যবস্থা হয়নি বলে হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।
পর্যটন শিল্প খাতকে বাঁচাতে ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণের সুদ মওকুফ করা, ঋণের কিস্তি আগামী বছরের জুনের আগে না নেওয়া ও ইউটিলিটি বিল মওকুফের দাবি তুলে ধরেন হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের সচিব হিমেল। পাশাপাশি সেবাখাতের জন্য সরকারের ঘোষিত ৩০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য বরাদ্দ দেওয়ারও দাবি জানান।
এবিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) মোহাম্মদ সাইফুল হাসান বলেন, পর্যটন শিল্পের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য আর্থিক সহায়তাসহ পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। “এই রিকভারি প্ল্যান বিশাল। তা বাস্তবায়নের জন্য গাইডলাইন তৈরি হচ্ছে। এখানে অনেক বিষয় আছে। প্রতিটি বিষয় ধরে আলাদাভাবে গাইডলাইন হচ্ছে। এটা ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়নের দিকে যাবে।” সূত্র : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।
Leave a Reply