করোনা মহামারির মধ্যেও চট্টগ্রামে এগিয়ে চলছে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ কর্ণফুলী টানেলের নির্মাণকাজ। গত রবিবার ভোরে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে কর্ণফুলী টানেলের বাঁ সারির কাজ শেষ হয়েছে। চায়না মিডিয়া গ্রুপ জানিয়েছে, এর মাধ্যমে বিদেশে চীনের উদ্যোগে তৈরি প্রথম বৃহদাকারের টানেল প্রকল্পের লক্ষ্য বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে। চীনের জন্য এই প্রকল্প হবে টানেল নির্মাণের নতুন মাইলফলক। দেশের প্রথম এই টানেল পরিচিতি পাবে ‘বঙ্গবন্ধু টানেল’ নামে। এই প্রকল্প নির্মাণের ফলে চট্টগ্রামের পরিবহন উন্নয়ন এবং বাংলাদেশের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেগবান হবে।
বাংলাদেশে এই প্রকল্পের কাজ করছে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কম্পানি (সিসিসিসি)। সিসিসিসি এই নির্মাণকাজ করছে চায়না রোড অ্যান্ড ব্রিজ করপোরেশনের মাধ্যমে। চীনের আমদানি-রপ্তানি ব্যাংক (এক্সিম ব্যাংক) এই প্রকল্পে শতভাগ অর্থায়ন করেছে। এই প্রকল্পে শিল্ড সেকশনের দুটি টিউব এবং চার লেনবিশিষ্ট নকশার কর্ণফুলী টানেল চট্টগ্রাম শহরকে কর্ণফুলী নদীর অন্য প্রান্তের সঙ্গে যুক্ত করবে। এই বহুমুখী রোড টানেল প্রকল্প দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নদীর তলদেশে স্থাপিত টানেল এবং চীনা কম্পানির তৈরি প্রথম বড় ব্যাসের নদীগর্ভস্থ টিবিএম টানেল।
কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী হারুনুর রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘এরই মধ্যে প্রকল্পের কাজ ৫৭ শতাংশ শেষ হয়েছে। প্রকল্পের সময়সীমা রয়েছে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। আশা করি, এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ হতে পারে।’
বাংলাদেশে সিআরবিসির কার্যালয়ের কর্মকর্তা পাং মিং বলেন, “বাংলাদেশ এই টানেল নির্মাণের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব তীরের উন্নয়ন বাস্তবায়নের আশাবাদী। টানেলের নির্মাণকাজের মাধ্যমে ‘একটি শহর ও দুটি নগর’ উন্নয়নের লক্ষ্য পূরণ হবে।”
প্রকল্পের মহাপরিচালক লি চেং বলেন, “নানা প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠতে সিআরবিসি বিশেষজ্ঞরা একটি টিম গঠন করে। প্রকল্পের বিশেষজ্ঞদল প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দেয়। আমরা সুনির্দিষ্ট নির্মাণ পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি এবং টানেলের প্রতিটি পদক্ষেপ বিশ্লেষণ করেছি। আমরা প্রকল্পের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী স্বতন্ত্রভাবে যে ‘শিল্ড মেশিন’ তৈরি করেছি তা প্রযুক্তিগত সমস্যা সমাধানের অন্যতম যন্ত্র।”
টানেল প্রকল্প নির্মাণ প্রক্রিয়ায় প্রথম লাইনের নির্মাণ শ্রমিকরা বিশাল ত্যাগ স্বীকার করেন। শুধু তা-ই নয়, চীনের অভ্যন্তরীণ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোও শক্তিশালী আস্থা জুগিয়েছে। এই মেশিন টানেলে অব্যাহতভাবে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে রিং সেগমেন্ট সুশৃঙ্খলভাবে স্থাপন করতে পারে। গোটা প্রকল্পে ২০ হাজারেরও বেশি রিং সেগমেন্ট লাগবে এবং একেকটি রিং সেগমেন্টের ওজন প্রায় ১৩ টন। এসব রিং সেগমেন্ট চীনে তৈরির পর ভালোভাবে প্যাকিং করে জাহাজে করে বাংলাদেশে আনা হয়।
বাংলাদেশে সিআরবিসির মহাপরিচালকের সহকারী পোং তেং চি বলেন, ‘আমাদের এই প্রকল্পের জন্য ব্যবহৃত রিং সেগমেন্ট তৈরি হয় চীনের চেন চিয়াং শহরে। পরিবহন প্রক্রিয়ায় ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য প্যাকেজের ক্ষেত্রে আমরা অনেক কাজ করি।’
নদীর তলদেশে টানেল প্রকল্পের বাঁ লাইন দিয়ে চলাচলের আগের রাতে চীনের প্রকৌশলীরা সারা রাত কাজ করেন। তাঁরা ‘রিয়াল টাইম মনিটরিং ডাটার’ ওপর নজর রাখেন। বাঁ লাইনের চলাচল সুষ্ঠু হওয়ার পর বিশ্রাম বা উদ্যাপন না করে তাঁরা নতুন যাত্রা শুরু করেন। চ্যানেলের ডান লাইনের প্রকল্পের দিকে মনোযোগ দেন তাঁরা।
বাংলাদেশে সিআরবিসির দায়িত্বশীল কর্মকর্তা পাং মিং বলেন, ‘বাঁ সারি দিয়ে চলাচল চালু হওয়ার মানে প্রকল্পের অর্ধেক কাজ শেষ হওয়া। আগের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে স্থানীয় ভূগর্ভস্থ পরিবেশ নিয়ে আমাদের জানাশোনা আরো গভীর হয়েছে, যা ডান লাইনের নির্মাণকাজে সহায়ক হবে।’
চায়না মিডিয়া গ্রুপ জানায়, যাঁরা বাংলাদেশের কর্ণফুলী নদীর তলদেশের টানেল প্রকল্পে অংশ নিচ্ছেন তাঁদের গড় বয়স ৩৫ বছর। বয়সে তরুণ হলেও বিদেশে গিয়ে বৈচিত্র্যময় কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করছেন তাঁরা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন জানান, কর্ণফুলী নদীর টানেল প্রকল্পের মাধ্যমে চীনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা নিয়ে আরো আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছেন তিনি। ভবিষ্যতে সেতু কর্তৃপক্ষ চীনের সঙ্গে আরো বেশি প্রকল্পে সহযোগিতা চালাবে।
Leave a Reply