সড়ক ও মহাসড়কে বিশৃঙ্খলা ও প্রাণহানির বড় কারণ বেপরোয়া মোটরসাইকেল। গত জানুয়ারি মাসে সারা দেশে সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলের কারণে। গত বছর সারা দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় জড়িত যানবাহনের মধ্যে মোটরসাইকেল ছিল দ্বিতীয় স্থানে। গত শনিবার রাত থেকে গতকাল রবিবার দুপুর পর্যন্ত রাজধানী ও তিন জেলায় ছয় মোটরসাইকেল আরোহীসহ সাতজন প্রাণ হারিয়েছেন। আগের দিন প্রাণ হারিয়েছেন জাতীয় হ্যান্ডবল দলের গোলরক্ষক সোহানুর রহমান সোহান।
মোটরসাইকেল এখন ঢাকা মহানগরে ‘মরণযান’ হিসেবে পরিচিত। অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল সেবার পাশাপাশি ঢাকার সড়কে চুক্তিতে যাত্রী পরিবহন করছে এই বাহনটি। বড় গাড়ির চেয়ে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন ঢাকায় প্রায় ২২ গুণ বেশি।
সারা দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের ২৫ শতাংশই ঢাকায়। দুই বছর আগে ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৩১৫টি প্রাইভেট কার নিবন্ধিত হতো। এখন সেটা নেমে এসেছে ৫০টিতে। অন্যদিকে এখন মোটরসাইকেল নিবন্ধিত হচ্ছে প্রতিদিন গড়ে ৪১৫টি।
২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর সড়কে শৃঙ্খলা আনতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দেওয়া ১৮ নির্দেশনার মধ্যে মোটরসাইকেল চালনায় সতর্কতা অবলম্বনের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে হেলমেট বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল। তার আগে থেকেই তিন আরোহী নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এখন আর মোটরসাইকেল চলাচলে কঠোর নজরদারি নেই।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মো. মফিজউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, ‘ঢাকার বাইরের জেলা থেকেও মোটরসাইকেল এনে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে বিভিন্ন অ্যাপে যুক্ত থাকার নামে। আমরা ঢাকার বাইরের মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করেছি।’
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান ড. মো. কামরুল আহসান বলেন, ‘আমরা সব ছোট গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করে বড় গাড়ি বাড়াতে চাই। ঢাকা শহরে এখন থেকে এসি বাস ও মিনিবাস ছাড়া সাধারণ বাস-মিনিবাস আর নামানো হবে না। মোটরসাইকেল কী পরিমাণ নিবন্ধন দিতে হবে তার একটা নীতিমালা আমরা করতে চাই।’
চলতি বছর প্রকাশিত বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির প্রতিবেদন অনুসারে, গত বছর পাঁচ হাজার ৫১৬ সড়ক দুর্ঘটনায় সাত হাজার ৮৫৫ জন নিহত ও ১৩ হাজার ৩৩০ জন আহত হয়েছে। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের তুলনায় প্রাণহানি ৮.০৭ শতাংশ বেড়েছে। সংঘটিত দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলের সংশ্লিষ্টতা ছিল দ্বিতীয় স্থানে, ২১.৪ শতাংশ। প্রথম স্থানে ছিল ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ২৯.৮১ শতাংশ। তৃতীয় স্থানে ছিল বাস, ১৮.৯৯ শতাংশ। অন্যান্য যানবাহনের মধ্যে দুর্ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা ছিল কার-জিপ-মাইক্রোবাস ৫.২২ শতাংশ, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ৯.৩৫ শতাংশ, ব্যাটারিচালিত রিকশা ও ইজি বাইক ৮.০৪ শতাংশ, নছিমন-করিমন-মহেন্দ্র-ট্রাক্টর ও লেগুনা ৭.৩২ শতাংশ।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুসারে, গত জানুয়ারিতে দেশে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে মোটরসাইকেলে। ৩৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় সবচেয়ে বেশি, ৮৯টি। অর্থাৎ মোট দুর্ঘটনার ২৬.১৭ শতাংশ। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয় ১০৩ জন, যা মোট নিহতের ২৩.১৪ শতাংশ। সংখ্যার দিক থেকে মোটরসাইকেলের আগে রয়েছে ট্রাক ও পিক-আপ, ৯৭টি। এ ছাড়া রয়েছে বাস ৭০টি, কাভার্ড ভ্যান ১৬টি, লরি ও ট্রাক্টর ২৩টি, কার ও মাইক্রোবাস ৩৩টি, বাইসাইকেল ১৬টি, নসিমন-করিমন-আলমসাধু-মহেন্দ্র-৮৭টি, ইজি বাইক ৩৩টি টমটম দুটি, পাওয়ার টিলার একটি, ট্রলি ও পুলিশ জিপ একটি করে।
রাজধানীতে বেপরোয়া চালক : রাজধানীর প্রধান সড়ক ও অলিগলিতে মোটরসাইকেলচালকদের কারণে পথচারী ও যাত্রীরা ত্যক্তবিরক্ত। বেশির ভাগ মোটরসাইকেলচালকই অন্য যানবাহনকে অতিক্রম যাওয়ার চেষ্টা করে সব সময়। সে ক্ষেত্রে তারা নিয়ম না মেনে উল্টোপথে, ফুটপাত দিয়েও বাহনটি চালিয়ে যায়। বাজাতে থাকে হর্ন। রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহার ছাড়াও চুক্তিতে মোটরসাইকেল চলছে রাজধানীতে। সে কারণে মোড়ে মোড়ে যেন মোটরসাইকেলের বাজার বসে।
বনানী, গুলশান, কুড়িল, বাড্ডা, ধানমণ্ডি-২৭, মৌচাক, মালিবাগ, শাহবাগ, সায়েদাবাদ, তেজগাঁও সাতরাস্তা, মগবাজার, বিমানবন্দর রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে ডেকে ডেকে যাত্রী তোলে মোটরসাইকেল চালকরা।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় আগারগাঁও মোড়ে যানজটে আটকে থাকা অবস্থায় মোটরসাইকেল চালকরা সমানে হর্ন বাজাচ্ছিল, যা যাত্রীদের বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সারি সারি মোটরসাইকেলের হর্ন বাজানো দেখে মনে হচ্ছিল চালকরা প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এ প্রতিবেদক বাজাজ প্লাটিনা ১০০ সিসি মোটরসাইকেলের যাত্রী হয়ে গন্তব্যে যাচ্ছিলেন। গাড়ির চালক ছগির হোসেন চলতে চলতে বলছিলেন, ‘বেশিবার ট্রিপ দিতে পারলে বেশি আয় হয়। সে কারণে দ্রুত চালানোর তাড়া থাকে।’ ‘পাঠাও’ এর নিবন্ধিত তাঁর মোটরসাইকেলটি তিনি শৃঙ্খলা না মেনেই চালাচ্ছিলেন। বেশির ভাগ সময় গাড়ির গতি ছিল ৬০ কিলোমিটারের আশপাশে। আগারগাঁও, বিজয় সরণি, বনানী, গুলশান-২, বাড্ডাসহ বিভিন্ন স্থানেও দেখা গেল মোটরসাইকেলচালকদের বেপরোয়া মনোভাব।
মোটরসাইকেলে প্রাণ ঝরছেই : ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে সড়ক-মহাসড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটেই চলেছে। গতকাল দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় বিএনএস সেন্টারের সামনে হাই চয়েস নামের একটি বাসের চাপায় রাসেল ভূঁইয়া (২৪) ও ফাহাদ বিন ফারুক (২৬) নামের দুই মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হন। এ ঘটনায় বাসের চালক রবিউল ইসলাম (৪০) ও তাঁর সহকারী আব্দুস সালামকে (৪৫) আটক করেছে পুলিশ। সেই সঙ্গে জব্দ করা হয়েছে কুষ্টিয়া ব-১১০০৪১ বাসটি।
পুলিশ জানায়, নিহত রাসেলের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার হোমনার দরিচর। তিনি যাত্রাবাড়ী এলাকার ধলপুরে থাকতেন। সেখানে থেকে চাকরি খুঁজছিলেন। আর ফাহাদের গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে। তিনিও যাত্রাবাড়ী এলাকায় থাকতেন। সেখানে ওষুধের দোকান চালাতেন। আরো চার বন্ধুসহ তাঁরা তিনটি মোটরসাইকেলে করে উত্তরা যাচ্ছিলেন। রাসেলের আত্মীয় মনিরুল হক বলেন, ‘আমি জানতাম সে যাত্রাবাড়ী থাকে। সেখানে থেকে চাকরি খুঁজছে। হঠাৎ দুর্ঘটনার কথা জানতে পেরে হাসপাতালে গিয়ে তার মৃতদেহ দেখতে পাই।’
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি তপন চন্দ্র সাহা বলেন, দুই বন্ধু মোটরসাইকেল চালিয়ে যাওয়ার সময় বাসটি তাঁদের ধাক্কা দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই রাসেল মারা যান। আহত অবস্থায় ফাহাদকে কুর্মিটোলা হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানে তাঁর মৃত্যু হয়।
গতকাল সকালে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের প্রসাদপুর মোড়ে দুর্ঘটনায় মারা গেছেন মোটরসাইকেলের দুই আরোহী। তাঁরা হলেন—পৌর এলাকার পুরাতন প্রসাদপুরের হঠাৎপাড়ার জয়নাল আবেদীন টিটু (২৫) ও একই এলাকার সিরাজুল ইসলাম (৪৫)।
একই দিন বিকেলে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার খারহাট এলাকায় ইঞ্জিনচালিত ভ্যানের সঙ্গে সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন মোটরসাইকেলচালকসহ তিনজন। নিহত ব্যক্তি ভ্যানের চালক শাহজান মিয়া (৫০)। তাঁর বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সস্রাইল এলাকায়।
চাঁদপুরের শাহরাস্তিতে বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালাতে গিয়ে গত শনিবার রাতে উপজেলার মেহের স্টেশন এলাকায় চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কে নিহত হন মো. শাহজাহান (৫০) ও আলমগীর হোসেন (৩৭)। তাঁদের বাড়ি উপজেলার দেবকরা গ্রামে। তাঁদের মোটরসাইকেলটিকে একটি ট্রাক ধাক্কা দেয়।
ওই দিন বিকেলে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের ভাগজোক কাস্টম মোড়ে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পার্শ্ববর্তী প্রাচীরে ধাক্কা লেগে চালক আলাল (১৯) নিহত হন।
গত শুক্রবার সকালে জাতীয় হ্যান্ডবল দলের গোলরক্ষক সোহানুর রহমান সোহান নিজের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার হোসেনাবাদে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়ে মারা যান। সোহান ও তাঁর চাচাতো ভাই জয় মোটরসাইকেলে করে স্থানীয় বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। স্থানীয় যান্ত্রিক যান নসিমনের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের পর পথেই মারা যান সোহান।
পুলিশ জানায়, একটি মোটরসাইকেলে তিনজনের ভ্রমণ নিষিদ্ধ। কিন্তু এ নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। গত ২০ ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে তিন বন্ধু মোটরসাইকেলে করে ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়ক ধরে যাচ্ছিলেন। ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের একটি বাস চাপা দিলে মো. ইমন মিয়া (১৭) নামের একজন নিহত হয়। সে ছিল কলেজশিক্ষার্থী।
Leave a Reply