বৈরুতকে চিনেছি পাঁচ বছর আগে। শুরুর দিনগুলোতে লেবাননের রাজধানী এই শহরকে অচেনা মনে হতো। দিনে দিনে ভূমধ্য সাগরপাড়ের শহরটা আপন হয়ে উঠেছে। কিন্তু গত কয়েক দিনে যে শহরকে দেখছি, এমন বৈরুত আগে দেখিনি। পুরো শহরের যেন মন খারাপ। করোনাভাইরাস সংক্রমণের সময় লকডাউনের কারণে এমনিতেই শহরে মানুষের আনাগোনা কম ছিল। এখন রাস্তাঘাট যেন জনমানবহীন। যাঁদের দেখা মেলে, তাঁদেরও মুখ ভার।
হঠাৎ করেই কী থেকে কী হয়ে গেল! ৪ আগস্ট সকালটাও তো আর দশটা দিনের মতো শুরু হয়েছিল। বৈরুত বন্দর থেকে আমার আবাসস্থলের দূরত্ব ছয় কিলোমিটার। আমার কর্মস্থল মানে বাংলাদেশ দূতাবাসও হাঁটা পথ। দূতাবাসে আমার আনুষ্ঠানিক পদ ওয়েলফেয়ার অ্যাসিস্ট্যান্ট; মানে দূতাবাসের পক্ষে লেবাননের প্রবাসী বাংলাদেশিদের কল্যাণে কাজ করা। সন্ধ্যা তখন সাড়ে ছয়টা। সেদিন অফিসের কাজ শেষ করে বেরিয়েছিলাম।
আনমনে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠল পৃথিবী। মনে হলো পায়ের নিচের মাটি চৌচির হয়ে যাচ্ছে। শহরটা হয়তো মাটির নিচে দেবে যাবে। ভূমিকম্প ভেবে মাথার ওপর দুই হাত রেখে নিরাপদ স্থানের খোঁজে দৌড় দিলাম। আশপাশে ফাঁকা জায়গা না পেয়ে রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাশেই নির্মাণাধীন একটা ভবন ছিল। সেটি রীতিমতো দোল খাচ্ছিল। আশপাশের সব ভবনের কাচ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে নিচে পড়ছিল। কাচপতনে ধুলায় ভরে গেল চারপাশ। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম ধোঁয়ার কুণ্ডলী।
মনে হচ্ছিল, মৃত্যুকে যেন কাছ থেকে দেখছি। কাছের মানুষেরা বলেন, আমি ভীষণ শক্ত প্রকৃতির মানুষ। কিন্তু সেদিন চারপাশে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল, হয়তো আর বাঁচব না। দেশে থাকা প্রিয়জনদের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না। তাঁদের মুখ ভেসে উঠছিল মনের কোণে। মনে পড়ছিল আমার অপূর্ণ স্বপ্নগুলোর কথাও।
একই জায়গায় পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম অনেকটা সময়। মানুষজন তখনো দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। শিশুদের চোখে–মুখে আতঙ্ক। আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে কেউ কেউ। ধাতস্থ হওয়ার পর অনেকের মতো আমারও মনে প্রশ্ন জাগল, ভূমিকম্প, নাকি অন্য কিছু?
পাশেই ছিল আমাদের দূতালয়প্রধান (হেড অব চ্যান্সেরি) আবদুল্লাহ আল মামুনের বাসা। উদ্বিগ্ন হয়ে চলে গেলাম তাঁর বাসায়। তাঁকেও আতঙ্কিত দেখলাম। দূতালয়প্রধান ফোন দিলেন বৈরুতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আল মুস্তাহিদুর রহমানকে। কথা বললেন। পুরো পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করতে নির্দেশ দিলেন তিনি। মুঠোফোনের নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পাওয়া যাচ্ছিল না, তবু সঙ্গে সঙ্গে আমরা যোগাযোগ শুরু করে দিলাম।
জানতে পারলাম, ঘটনাস্থল বৈরুত বন্দর। সেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষার দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশি নৌবাহিনীর জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমাদের সাহায্য চাইলেন তাঁরা। আমরা তৎপরতা শুরু করলাম। রেডক্রসকে জানানো হলো। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত বৈরুত আঞ্চলিক কার্যালয়কে জানানো হলো। তাঁদের কাছে চিকিৎসার জন্য সহায়তা চাওয়া হলো।
আমি ও দূতালয়প্রধান চললাম বন্দরের দিকে। পথে পথে প্রতিবন্ধকতা। রাস্তায় গাছ উপড়ে পড়ে আছে। পড়ে আছে ভাঙা কাচ আর ধসে পড়া ভবন। যেন এক বিধ্বস্ত নগরীর পথে নেমেছি। বিকল্প পথ ব্যবহার করলাম আমরা। বন্দর পাঁচ মিনিটের দূরত্ব, লাগল আধা ঘণ্টা। বিস্ফোরণস্থল থেকে ৩০০ মিটার দূরে আমাদের অবস্থান। সেখানেই শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর জাহাজ। জাহাজটির সামনের অংশ ভেঙে গেছে।
নামতেই হতবাক। অনেক নাবিক আহত হয়েছেন। কারও অবস্থা সংকটাপন্ন। মানুষজন দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সশব্দে পরিবেশ ভারী করে তুলেছে। এ যেন এক মৃত্যু–উপত্যকা। হেলিকপ্টার চলে এল ঘটনাস্থলে পানি ছিটাতে। বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি, বন্দরের যে দোকান থেকে মাঝেমধ্যে চকলেট কিনতাম, সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে সে দোকানের পাশের আরও অনেক দোকান।
মুঠোফোন আমার হাতেই ছিল। নেটওয়ার্ক সংযোগ পেয়েছিল সম্ভবত। মুহুর্মুহু বার্তা আসতে থাকল। মা ফোন দিয়েছিলেন, বড় ভাই ফোন দিয়েছিলেন। মেসেঞ্জারও ভরে গেছে। বার্তা দেখে বুঝলাম দেশে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুরা উৎকণ্ঠিত।
উদ্ধারকারী দলের অপেক্ষায় ১৫-২০ মিনিট কাটিয়ে দিলাম। কিন্তু উদ্ধারকারী দল আসতে পারল না। জানাল, পথ–ঘাটে নানা প্রতিবন্ধকতা। উপায় না পেয়ে নিজেরাই উদ্যোগী হলাম। আমাদের রাষ্ট্রদূত আহত লোকজনকে বহনের জন্য তাঁর গাড়ি ব্যবহারের নির্দেশ দিলেন। দূতাবাসের গাড়িতে তোলা হলো আহত পাঁচজনকে।
একজনের মাথায় কাচ ঢুকে গেছে। তাঁর অবস্থা সংকটাপন্ন। মাথায় আঘাত পেয়ে আরেকজন অবচেতন হয়ে আছেন। একজনের হাত ভেঙে গেছে। আর দুজন আহত। আহত এক ব্যক্তি কাতর কণ্ঠে জানালেন, তাঁরা অনেকে ২০ মিটার দূরে গিয়ে ছিটকে পড়েছিলেন। কীভাবে বেঁচে আছেন, নিজেরাও জানেন না। তিনি যে বেঁচে আছেন, সেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার তাঁর চোখে–মুখে ফুঠে উঠেছিল।
হাসপাতালে পৌঁছে দেখি, শত শত মানুষ আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য আসছেন। স্বজনদের আহাজারিতে চারপাশ ভারী হয়ে উঠেছে। সে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। কয়েকজন বাংলাদেশিকে আহত অবস্থায় পেলাম। তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা হলো। সংকটাপন্ন লোকজনকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়া হলো।
ততক্ষণে ঘটনার এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেছে। বেঁচে আছি, সুস্থ আছি, এটুকু জানিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলাম। কিন্তু বাসায় কথা বলার সুযোগ হলো না। একটা ঘোরের মধ্যে তখন যেন আমি। এ দেশে প্রায় দেড় লাখ বাংলাদেশির বসবাস, যাঁদের মধ্যে শুধু বৈরুত শহরেই আছেন প্রায় ৩০ হাজার।
পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবেই বাংলাদেশিদের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছিলাম। তাৎক্ষণিকভাবে না জানলেও পরদিন আহত অনেকের তথ্য পাওয়া গেল। বিভিন্ন হাসপাতলে চিকিৎসাধীন বাংলাদেশিদের দেখে কষ্ট লাগল। পরিবার ছেড়ে দূর দেশে এই মানুষেরা কী কষ্টই না করেন। তাঁদের কেউ কেউ তখন লড়ছেন মৃত্যুর সঙ্গে। দূতাবাসের হিসাবে এখন পর্যন্ত ১০৮ জন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন, মারা গেছেন ৫ জন। একটা দুর্ঘটনা কত মানুষের স্বপ্ন কেড়ে নিল।
৪ আগস্ট আকস্মিক পরিস্থিতিতে আমরা যেন ঘোরের মধ্যে ডুবে ছিলাম। সেই ঘোর থেকে আজও বের হতে পারিনি। এর পরও দুদিন বন্দর এলাকায় গিয়েছি। এখন দৃষ্টিনন্দন ভবনগুলো শ্রীহীন হয়ে পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর। বৈরুতের দোকানগুলো ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বন্দর বন্ধ বলে পণ্য আসছে না। দাম বাড়ছে হু হু করে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছে। অথচ এই শহরকেই অনেকে বলেন মধ্যপ্রাচ্যের স্বর্গ। তাই প্রত্যাশা করি, বৈরুত আবার ঘুরে দাঁড়াবে। আবার হাসবে এখানকার মানুষ। প্রথম আলো।
Leave a Reply