1. paribahanjagot@gmail.com : pjeditor :
  2. jadusoftbd@gmail.com : webadmin :
মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৩ অপরাহ্ন
শিরোনাম:
সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি হলেন স্টার লাইনের হাজী আলাউদ্দিন তরুণরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণে নামুক আবার পেট্রোনাস লুব্রিক্যান্টস বিক্রি করবে মেঘনা পেট্রোলিয়াম অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশে ভারতীয় সব ভিসা সেন্টার বন্ধ মন্ত্রী এমপিদের দেশত্যাগের হিড়িক : নিরাপদ আশ্রয়ে পালাচ্ছেন অনেকেই বাস ড্রাইভার নিকোলাস মাদুরো আবারও ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট ইউএস-বাংলার দশম বর্ষপূর্তি : ২৪ এয়ারক্রাফট দিয়ে দেশে বিদেশে ২০ গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা এয়ার ইন্ডিয়ার যাত্রী পরিবহন তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বিশ্বখ্যাত মোটরসাইকেল ব্র্যান্ড রয়েল এনফিল্ড খুব শিগগিরই বাজারে আসছে সিঙ্গাপুরের পতাকাবাহী এমটি কনসার্টো জাহাজে বাংলাদেশী নাবিকের মৃত্যুর তদন্ত দাবি

ফাহিম, আদুরে ভাইটি আমার…

রুবি অ্যাঞ্জেলা সালেহ
  • আপডেট : রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২০

‘বড় ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরে চুলে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে সব ঠিক করে দিই।’

[গত মাসে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে নিজ অ্যাপার্টমেন্টে নৃশংসভাবে খুন হন বাংলাদেশের জনপ্রিয় রাইড শেয়ারিং অ্যাপ ‘পাঠাও’-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ। তার বড় বোনের এই শোকগাথা]

জুলাইয়ের ১৪ তারিখ, রাত ১০টা ৪৭ মিনিটে বেজে উঠল আমার ফোন। স্বামীর পাশে শুয়ে ছিলাম, সবে ঘুম নামতে শুরু করেছে চোখে—তবু ফোনটা ধরলাম। কারণ নিউইয়র্ক থেকে আমার ফুফু করেছেন কলটা।
ফোন ধরতেই তিনি বললেন, ‘খুব খারাপ একটা খবর আছে।’
তার কণ্ঠে আতঙ্ক; ইচ্ছার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। সঙ্গে সঙ্গে বুঝে গেলাম, নিকটাত্মীয়দের কারও খুব খারাপ কিছু হয়েছে। চিন্তাটা মাথায় আসতেই আমার কাঁধ আড়ষ্ট হয়ে গেল, অসাড় হয়ে গেল বাকি শরীর। বাবা-মার কোভিড ধরা পড়ল না তো?
‘কী হয়েছে?’ জানতে চাইলাম; নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ফোনটা লাউডস্পিকারে দিলাম, যাতে স্বামীও শুনতে পায়।
‘খুব খারাপ খবর,’ ফুফু বললেন।
‘কী হয়েছে বলো তো, ফুফু?’
‘আমাদের ফাহিম আর নেই,’ জবাব দিলেন উনি।
তার কথার মানে বুঝতে পারছিলাম না। ‘কী বলতে চাইছ?’ মাত্র ৩৩ বছর বয়সি প্রাণচঞ্চল, সৃজনশীল, সুস্থ, সুন্দর ছোট্ট ভাইটা আমার ‘নেই হয়ে যায়’ কীভাবে?
ফুফু বললেন, ‘ওকে খুন করা হয়েছে।’
‘কী বলছ তুমি এসব?’ চেঁচিয়ে উঠলাম।
ফোন কেটে দিয়ে আমার বোনকে কল করলাম। ফোন রিসিভ করেই আমার নাম ধরে কেঁদে উঠল ও। জানাল, ও ডিটেকটিভের সঙ্গে আছে, বেশিক্ষণ কথা বলতে পারবে না। বলল, “অনেকক্ষণ ধরে ওর কোনো খবর পাচ্ছিলাম না, তাই ‘এ’ ওর অ্যাপার্টমেন্টে গিয়েছিল খোঁজ নিতে।” ‘এ’ আমার ৩০ বছর বয়সি কাজিন।
ঠিকমতো গাড়ি চালাতে শেখার আগেই সফল প্রযুক্তি-উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছিল ফাহিম। ওকে দেখেই কোডার হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছিল ‘এ’।
“লিভিং রুমে ‘এ’ ওর মাথাবিহীন ধড় খুঁজে পেয়েছে,” আমার বোন জানাল। ‘আমাকে এখন যেতে হবে, ডিটেকটিভের সঙ্গে আছি।’
ফোনটা হাত থেকে ফেলে দিয়ে কাঠের মেঝেতে বসে পড়লাম হামাগুড়ি দিয়ে। ঠাণ্ডা, শক্ত কাঠের মেঝের স্পর্শ নিতে লাগলাম হাতের তালুতে। বারবার মাথা নেড়ে বলতে লাগলাম, ‘না, না, এসব কী বলছে ওরা?’
চোখ তুলে বরের দিকে তাকালাম। ঝরঝর করে কাঁদছে ও, আমার ভাইয়ের মৃত্যুসংবাদটা বিনা-বাক্যে সত্যি বলে মেনে নিয়েছে। ওর কান্না আমার কাছে অর্থহীন মনে হলো; কারণ খবরটা খুব সম্ভবত সত্যি নয়।
পরদিন আটলান্টিকের ওপার থেকে উড়ে গেলাম নিউইয়র্কে।
ইন্টারনেট জুড়ে আমার ভাইয়ের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে রয়েছে। একটা খবরের শিরোনাম: ‘ম্যানহাটনের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সিইও-র খণ্ডিত লাশ উদ্ধার।’ আরেকটার শিরোনাম—’বৈদ্যুতিক করাতের সাহায্যে মস্তক ও হাত-পা আলাদা করা লাশ উদ্ধার এনওয়াইসি পুলিশের।’ এই খণ্ডিত লাশটাই আমার ছোট ভাই ফাহিম। আমার ফাহিম—যাকে আমার বয়স যখন আট, তখন হাসপাতাল থেকে ছোট্ট একটা কমলা রঙের পশমি কম্বলে মুড়িয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছিলেন বাবা-মা।
বড় হওয়ার সময় নিজেকে আমার যতটা না ফাহিমের বোন মনে হতো, মা মনে হতো তারচেয়ে অনেক বেশি। ও যখন সবে হাঁটতে শিখেছে, তখন আমি চামচে করে ভাত আর মুরগির মাংস নিয়ে সারা বাড়ি ওর পিছু পিছু দৌড়ে বেড়াতাম ওকে খাওয়ানোর জন্য। ওকে গোসল করাতাম, ওর ডায়াপার বদলে দিতাম। প্রথম যেদিন ওর নাক দিয়ে রক্ত ঝরতে দেখে, সেদিন আতঙ্কে কাঠ হয়ে গিয়েছিলাম। ওর ছোট্ট হলুদ শার্টটা রক্তে ভিজে উঠতে দেখে ভেবেছিলাম, ভয়ংকর কিছু হয়েছে আমার ভাইয়ের।
ওর বয়স তখন তিন। আমার এগারো। তার ত্রিশ বছর পর সেই আমি শুনলাম ফাহিমের মাথা-হাত-পা কেটে ময়লা ফেলার ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখেছে কেউ। আমার ভাইয়ের শরীরটাকে কেটে টুকরো টুকরো করে ময়লা ফেলার ব্যাগে পুরে দিয়েছে—যেন ওর জীবনের,ওর শরীরের, ওর অস্তিত্বের কোনো মূল্য নেই।
বানের মতো মেসেজ আসতে শুরু করেছে বন্ধুদের কাছ থেকে। ‘কী বলব বুঝতে পারছি না’—এই হলো বেশিরভাগ মেসেজের শুরু। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের একজনকে উত্তর দিলাম,”ওহ, ‘এল’,কে এরকম করতে পারল আমার মিষ্টি বাচ্চা ভাইটার সঙ্গে? এখনও মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্ন দেখছি যেন…আহা রে,ভাই আমার!’
প্রথম কয়েকদিন আমরা বাবা-মাকে যথাসম্ভব রেখে-ঢেকে বলেছি। তবে আমি আর আমার বোন কথা বলেছি খোলাখুলি। একই চিন্তা ঘুরছিল আমাদের দুজনের মাথায়—ও কি ভয় পেয়েছিল? প্রাণভিক্ষা চেয়েছিল খুনির কাছে? খুব কষ্ট পেয়েছিল ও? পেলে কতটা কষ্ট পেয়েছে?
ভেবেছিলাম, আমরা সব জানতে চাই; কিন্তু অন্তরের গভীরে ঠিকই জানতাম, আমরা এটুকু স্বস্তি পেতে চাই যে, মৃত্যুর সময় ও কষ্ট বা ভয় পায়নি। নিজেদেরকে বোঝাতে চাইছিলাম, খুব দ্রুত আর বিনা কষ্টে চলে গেছে ও। বড় ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরে চুলে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে সব ঠিক করে দিই।
খবরটা শোনার ৪৮ ঘণ্টা পর ফোন পেলাম ফিউনারেল হোম থেকে। আমি তখন কাজিন আর বোনের সঙ্গে কাজিনের বিছানায় বসে আছি। ফোন করা লোকটা জানাল, কোভিডের কারণে তার পাঠানো ছবি দেখে ভাইয়ের মৃতদেহ শনাক্ত করতে হবে আমাকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চলে এলো মেসেজ। সঙ্গে সঙ্গে বমি-বমি ভাব হতে লাগল আমার। মেসেজে আসা ছবিটা খোলার আগে কিছুক্ষণ প্রার্থনা করলাম বোন আর কাজিনের হাত ধরে। এরপর খুললাম মেসেজটা, তারপরই দেখতে পেলাম ছবিটা—আমার মিষ্টি ভাই, দেহে প্রাণের চিহ্ন নেই।
হাউমাউ করে কেঁদে উঠল আমার বোন। বারবার বলতে লাগল, ‘না, না, সত্যিই ও আর নেই। সত্যিই নেই।’
শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম ওকে। ভাইয়ের ছবিটাকে জিজ্ঞেস করতে চাইলাম, ‘কী করে তোর সঙ্গে এসব হলো, সোনা?’
কম্পিউটারের পর্দায় ফুটে ওঠা ওর চেহারায় আঙুল বোলাতে লাগলাম। অশ্রু বইছে দু-গাল বেয়ে। কাঁদতে কাঁদতে বলতে চেষ্টা করলাম, ‘আমি স্যরি, ফাহিম, আমি স্যরি। মাফ করে দিস আমাকে। সোনা ভাইটা আমার। কলিজার টুকরা আমার।’
আমাদের কান্নার আওয়াজ শুনে দরজায় টোকা দিলেন বাবা। কী হয়েছে, জানতে চাইলেন। ঝটপট কম্পিউটার বন্ধ করে চোখ-মুখ মুছে বললাম, কিছু হয়নি। ছবিতে যা দেখেছি, তা কখনো বাবাকে বলতে পারিনি আমরা।
আমাদের পরিবারের শেকড় বাংলাদেশে। বাবা ওখানে ক্যানভাস বিক্রেতার কাজ করতেন। আমরা ছিলাম নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। ১৯৮৫ সালে কম্পিউটার বিজ্ঞানে ডিগ্রি লাভের পর সৌদি আরবে অধ্যাপনার চাকরি নেন বাবা। উন্নত জীবনের আশায় সে দেশে চলে যায় আমাদের তিনজনের পরিবার। ফাহিমের জন্ম ১৯৮৬ সালে। ও ছিল প্রাণচঞ্চল, কৌতূহলী, বুদ্ধিমান আর হাসিখুশি একটা বাচ্চা। প্রযুক্তির প্রতি ওর ভালোবাসার শুরু সেই ছোটবেলা থেকেই। কোনো খেলনা উপহার পেলেই ওটার কলকব্জা খুলে দেখত; বোঝার চেষ্টা করত জিনিসটা কীভাবে বানানো হয়েছে।
আমি বড় হওয়ার পর বাবা আমার পড়ালেখা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। তাই ১৯৯১ সালে, আমার বয়স যখন বারো, ফাহিমের চার, আর আমার বোন কোলের শিশু—যুক্তরাষ্ট্রে চলে এলাম আমরা।
লুইজিয়ানায় থিতু হলো আমাদের পরিবার। বাবা ওখানে কম্পিউটার সায়েন্সে পিএইচডি শুরু করলেন; মা কাজ করতেন স্থানীয় এক লন্ড্রিতে। বাবার সামান্য বৃত্তি, মায়ের নগণ্য রোজগার আর আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার করা টাকায় চলত আমাদের সংসার। সেই গ্রীষ্মে আমি প্রথমবার ঘণ্টাপ্রতি এক ডলারের বিনিময়ে বেবিসিটারের কাজ করলাম। দীর্ঘদিন মাত্র পাঁচটা টি-শার্ট আর দু-জোড়া প্যান্ট ছাড়া আমার আর কোনো কাপড় ছিল না। বাবা যে সংগ্রাম করতেন, তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ফুটে থাকত আমাদের দুই বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টের প্রতিটা কোনায়।
বিয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকায় না এসে, তিন সন্তান হওয়ার পর আসার জন্য প্রায়ই আফসোস করতেন তিনি। বলতেন, ‘এত দেরিতে কেউ আমেরিকা আসে না। এখানে কোনোকিছু বিনা পয়সায় মেলে না। আমেরিকায় থিতু হতে অনেক বছর লেগে যাবে আমাদের।’
বাবার কষ্ট দেখতে একটুও ভালো লাগত না আমার আর ফাহিমের। তার কষ্ট আর যন্ত্রণার ভার লাঘব করার তীব্র ইচ্ছাই সাফল্যের পথে নিয়ে যায় আমাদের।
• অনুবাদ: মারুফ হোসেন
সূত্র: মিডিয়াম ডটকম ও টিবিএস

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই বিভাগের আরও খবর
© 2020, All rights reserved By www.paribahanjagot.com
Developed By: JADU SOFT