:
মানুষের মৌলিক চাহিদায় নতুনতম এবং ষষ্ঠ সংযোজন হচ্ছে বিনোদন। মহামারি করোনায় মানুষ বন্দি ঘরে আর পর্যটন স্পটগুলো বন্দি প্রকৃতির কাছে। এই ফাঁকে প্রকৃতি সেজেছে তার আপন মহিমায়। তার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চল এবং দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের নতুন নতুন পর্যটন স্পটগুলো। ক্ষুদ্র আয়তনের এসব বিনোদনকেন্দ্র সম্বন্ধে স্থানীয় ও জাতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচারণা চলছে। এখন কেবল প্রয়োজন সুসংগঠিত পৃষ্ঠপোষকতার। দেশের সর্বাধিক পরিচিত বিনোদনকেন্দ্রগুলোও এই দীর্ঘ বিরতিতে গুছিয়ে নিচ্ছে নিজের আসল সৌন্দর্য। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের পাড় ঘেঁষে তৈরি হয়েছে সবুজের কার্পেট। সমুদ্রে হরহামেশাই দেখা মিলছে ডলফিন, কচ্ছপ আর লাল কাঁকড়ার। এর ফলে নতুন করে আশা জাগিয়েছে স্কুবা ড্রাইভিং সেবার।
পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি আর বান্দরবান লকডাউনে হয়ে উঠেছে আরও রহস্যময় এবং অভিযাত্রীসুলভ। কিছুদিন পূর্বেই বান্দরবানের কেউক্রাডং চূড়া ভ্রমণের নতুন এবং গাড়ি নিয়ে ওঠার পথ আবিস্কৃত হলেও, করোনায় পর্যটক শূন্যের কোঠায় থাকায় সেই উদ্যোগ তেমন সফল হতে পারেনি। এখন পর্যন্ত দেশের একমাত্র করোনামুক্ত জেলা রাঙামাটি। ঝুলন্ত ব্রিজ, কাপ্তাই লেক, শুভলং ঝরনা, সাজেক ভ্যালি ছাড়াও নতুন সংযোজন বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র, পেদা টিং টিং রেস্তোরাঁ ও উপজাতীয় জাদুঘর। এগুলো একদিকে যেমন প্রকৃতিপ্রেমীদের আকৃষ্ট করছে, তেমনি দেশ-বিদেশের গবেষক ও জ্ঞানপিপাসুদের নতুন চারণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। চট্টগ্রামের হালদা নদী রুই জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক মৎস্য আহরণ ক্ষেত্র। এটি দেশের এবং পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মৎস্য প্রজননস্থল। মৎস্য অধিদপ্তরের সূত্র মতে, এ বছর হালদা নদীতে রেকর্ড পরিমাণ ডিম পাওয়া গেছে। সারাদেশের চাষিরা হালদা নদী থেকে মাছের ডিম ও পোনা সংগ্রহ করছে। করোনার দরুন বিপুল সম্ভাবনার এই সম্পদ এবার সুষ্ঠু বণ্টন এবং উৎপাদনের পীড়ায় পড়েছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্পান যতটা ক্ষতি করেছে সুন্দরবনের, করোনা মহামারি ঠিক ততটাই সুযোগ করে দিয়েছে গাছপালা, পশুপাখি ও সরীসৃপকে। বনের ভেতরে পূর্বের সাতটির সঙ্গে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে আরও চারটি পর্যটন স্পট। পর্যটকদের বিনোদনের জন্য এখানে আছে জেটি, ওয়াচ টাওয়ার, উডেন ট্রেক, কুমির এবং হরিণ প্রজনন কেন্দ্র। নতুন করে আরও ১৩টি স্থান বাঘের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করায় বাঘের সংখ্যাও বিগত দুই-তিন বছর ধরে বাড়ছে। বন বিভাগের হিসাবে, এবার রেকর্ড পরিমাণ মধু সংগ্রহ করা হয়েছে সুন্দরবন থেকে। কুয়াকাটার অদূরে আরও দুটি লাল কাঁকড়ার দ্বীপ নজর কেড়েছে সবার। দেশে এখন বেশ কিছু মেগা প্রকল্প একসঙ্গে চলমান। এর কারণে বহু বিদেশি এ দেশে আসছেন এবং পাঁচতারকাসহ অন্যান্য মানসম্মত হোটেলে থাকছেন। করোনার দরুন আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ থাকায় হোটেলগুলো পড়েছে বিপাকে। তবুও থেমে নেই কর্মযজ্ঞ। এ ছাড়া নবনির্মিত বিশ্বমানের আরও সাতটি পাঁচতারকা হোটেল নির্মিত হচ্ছে ঢাকা, কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও সিলেটে। মহামারি পরবর্তী এই হোটেলগুলো হবে লাখো মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস।\হকরোনার কারণে আন্তর্জাতিক পর্যটনে বেশ পরিবর্তন আসবে। বিমান ভাড়া বাড়ার পাশাপাশি অনেক বিধিনিষেধ আরোপ হবে ভ্রমণের ক্ষেত্রে। ফলে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণির যেসব পর্যটক থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, নেপাল বা সমমানের দেশে যেতেন তারা করোনা-পরবর্তী সেসব দেশ ভ্রমণে সতর্ক হবেন। টানা অনেকদিন বাসায় থাকার দরুন মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে যে বিরক্তি এবং সচেতনতা তৈরি হয়েছে, তাতে তারা বিদেশে যাওয়ার ঝামেলা না নিয়ে নিজ দেশেই ঘুরতে বেরোবেন। এতে দেশের পর্যটন খাতে সৃষ্টি হবে সফল বিনিয়োগের সম্ভাবনা।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক ভ্রমণের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল হলেও বিমান সংস্থাগুলোকে বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত খরচ গুনতে হচ্ছে। কারণ আগের মতো সব যাত্রীকে পাশাপাশি বসতে দেওয়া যাচ্ছে না। একটি বিমান যেখানে ১০০ যাত্রী পরিবহনে সক্ষম, সেখানে এখন ৫০ জনের মতো উঠছেন। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে করোনা পরীক্ষার সনদ প্রদর্শন। বুকিং সাইট ট্রাভেলোসিটির তথ্য মতে, এই সময়ে তারা যতগুলো ভ্রমণের বুকিং পেয়েছে তার বেশির ভাগই ভ্রমণকারীর বাড়ির একশ’ মাইলের ভেতরে। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ি ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকবে না, কিন্তু ঢাকা থেকে সিকিম কিংবা ব্যাংকক যেতে অনুসরণ করতে হবে নানা গাইডলাইন। আর ওই এলাকা যদি করোনা হটস্পট হয়ে থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। এতে বোঝাই যাচ্ছে, বিনিয়োগের জন্য করোনা-পরবর্তী দেশীয় বাজারটি হবে বিশাল পরিমাণের।
করোনা মহামারির জন্য বিশ্ব মূলত চীনকে দায়ী করে আসছে শুরু থেকেই। তার সঙ্গে নতুন মাত্রা যোগ করেছে হংকং ইস্যু। এর ফলে করোনা-পরবর্তী সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ চীন থেকে অন্যত্র স্থানান্তর করা হচ্ছে, এবং সেটি বাংলাদেশের জন্য বিশ্ব অর্থনীতির পক্ষ থেকে একটি সুসংবাদ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, জার্মানি এবং অন্যান্য দেশের কোম্পানিগুলো এরই মধ্যে সুবিধাজনক স্থান হিসেবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করছে। কোম্পানি স্থানান্তরের দরুন এসব দেশ থেকে পর্যটক আসার সম্ভাবনাও বেড়ে গেছে। ফলে দ্বার খুলেছে সফল বিনিয়োগের।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত কিংবা পাকিস্তানের পর্যটন রাজনৈতিক অস্থিরতা, চীনের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থা, করোনা মহামারি ইত্যাদি নানা কারণে এখন বিপর্যস্ত। কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা অনেকটাই শান্ত। এর দরুন খোদ তাদের দেশ থেকেই বাংলাদেশে বিনিয়োগের পরিমাণ গত বছরের চেয়ে বেশি আসছে বলে জানিয়েছে ইনভেস্টমেন্ট কমিশন অব বাংলাদেশ।
কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে পর্যটন খাতকে পুনরায় উজ্জীবিত করতে বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের চিন্তা করছে সরকার। যেসব পণ্য পর্যটনের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট, তাদের ওপর থেকে শুঙ্ক ও কর মওকুফ করে পর্যটন পুনরুদ্ধারে সরকার দৃঢ় প্রত্যয়ী। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্য মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ পর্যটকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। করোনায় দীর্ঘ বন্দি জীবন পরবর্তী এই সংখ্যা আরও বাড়বে নিঃসন্দেহে। তখন তাদের এই বাড়তি চাপ সামাল দিতে না পারলে পর্যটন থেকে কাঙ্ক্ষিত মুনাফা অর্জন সম্ভব হবে না। দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যটকদের পরবর্তী গমনস্থল হতে চলেছে বাংলাদেশ।
পর্যটন এমন একটি শিল্প. যা আরও ৫৯টি খাতকে সরাসরি প্রভাবিত করে। এর মধ্যে যোগাযোগ, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি অন্যতম। প্রতিদিনই এই শিল্পের পরিসর বাড়ছে। অন্য যে কোনো শিল্পের উত্থান-পতন থাকলেও পর্যটন সেগুলো থেকে ব্যতিক্রম। সুতরাং এখানে বিনিয়োগের ঝুঁকি কম, সম্ভাবনা বেশি। আর করোনা-পরবর্তী সময়ে সেই সম্ভাবনা আরও বাড়বে, কারণ পর্যটকদের তখন বিভিন্ন সেফটি গিয়ারস এবং অব্যবহূত ফ্রেশ পণ্যের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেবে। পর্যটন শিল্পে সামান্য প্রণোদনা দিলেই তা অন্য যে কোনো প্রধান শিল্পকে টক্কর দিতে সক্ষম হবে। বিনিয়োগবান্ধব পর্যটন শিল্প দেশের বিপুল যুবসমাজের কর্মসংস্থানের চাহিদা অনেকটা সামাল দিতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন কেবল সরকারের সদিচ্ছা আর ব্যবসায়ীদের সুনজর। করোনা-পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পর্যটন হতে পারে ঘুরে দাঁড়ানোর মূলমন্ত্র।
লেখক: শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply