পাহাড়ের বুক চিরে আছড়ে পড়ছে প্রবহমান শুভ্র জলধারা। গুঁড়ি গুঁড়ি জলকণা আকাশের দিকে উড়ে গিয়ে তৈরি করছে কুয়াশার আভা। স্রোতোধারার কলতানে নিক্বণ ধ্বনির উচ্ছ্বাস। শীতলতার পরশ, যেন সবুজ অরণ্যে প্রাণের ছোঁয়া এঁকেছে কেউ। বলছি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা অপূর্ব নৈসর্গিক সৃষ্টি রাঙামাটির পাহাড়ি ঝরনাগুলোর কথা। সম্প্রতি টানা বৃষ্টিতে এক অন্যরকম রূপ ধারণ করেছে পাহাড়ি ঝরনাগুলো। তা দেখতে প্রতিদিনই স্থানীয় পর্যটকদের ভিড় জমছে ঝরনাস্থলে। মন কেড়েছে আশপাশ জেলার পর্যটদেরও। ঝরনার আকর্ষণ করোনার ভয়কেও যেন ম্লান করেছে সবার মধ্যে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাঙামাটি জেলায় অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড়ি ঝরনা থাকলেও নয়নাভিরাম ও বিস্ময়কর প্রাকৃতিক প্রাচুর্য শুধু রাঙামাটির বরকল উপজেলার শুভলং ইউনিয়ন ও ঘাগড়া ইউনিয়নে দৃশ্যমান। রাঙামাটি শহর থেকে ৩০-৩৫ কিলোমিটার দূরে বরকল উপজেলার শুভলং ইউনিয়ন। ইঞ্জিনচালিত বোট বা স্পিডবোটে শহর থেকে যেতে সময় লাগে এক থেকে দুই ঘণ্টা। অপরূপ কাপ্তাই হ্রদে ভাসতে ভাসতে দেখা মিলবে অসংখ্য সবুজ পাহাড়। দুই পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এসেছে ছোট-বড় অন্তত আটটি ঝরনা। এর মধ্যে মূল অর্থাৎ গিরিনির্ঝর ঝরনাটি সত্যি আকর্ষণীয়! প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে বর্ষায় জলধারার অবিরাম পতনে সৃষ্ট নিক্বণ ধ্বনিসমেত অপরূপ দৃশ্য না দেখলে কল্পনায়ও সে ছবি আঁকা অসম্ভব। বৃষ্টির প্রবল বর্ষণে যখন পাহাড় ফিরে পায় তার নব যৌবন, গিরিনির্ঝর ঝরনা তখন ফিরে পায় তার আদি রূপ। অপরূপ সৌন্দর্যে ভরা এ ঝরনা সেজেছে নবরূপে। ঝরনার সতেজতায় পাহাড়ি ঝিরিগুলো হয়ে উঠেছে প্রাণচঞ্চল। সাঁই সাঁই করে ধেয়ে চলে ঝিরির জলরাশি মিলেছে হ্রদের প্রাণে। বহু আগেই দেশ-বিদেশে ব্যাপক পরিচিতির বিস্তৃতি ঘটেছে রাঙামাটি শুভলং গিরিনির্ঝর ঝরনার। পাহাড়ে ঝরনার শীতল ও চঞ্চলা জলধারা সব পর্যটককেই কাছে টানে সহজে। তাই বর্ষা এলেই ঝরনার স্পটে ভিড় জমে দেশি-বিদেশি পর্যটকের। তবে করোনার কারণে এবার বিদেশ কিংবা দেশের অন্যান্য জেলার পর্যটকদের রাঙামাটিতে আগমন না থাকলেও ঝরনার ভিড় কিন্তু কমেনি। স্থানীয় অধিবাসীদের পদচারণে মুখর ঝরনার স্পটগুলো, যা দেখে হৃদয়-মন জুড়ে সৃষ্টি করে শিহরণ।
তবে এ ঝরনা ঘিরে পর্যটন কেন্দ্র করা হলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মরতে শুরু করেছে শুভলং ঝরনা। একই পরিস্থিতি কলাবাগান ঝরনার। কলাবাগান ঝরনা জেলার কাউখালী উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। এ ইউনিয়নের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য পাহাড়ি ছড়া। পাহাড়ি ছড়াগুলোর একমাত্র উৎপত্তিস্থল ঘাগড়া ঝরনা, যা সবার কাছে ‘কলাবাগান’ ঝরনা নামে পরিচিত।
এখানে শুধু দেশি-বিদেশি পর্যটক নয়, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ আশপাশের জেলার অধিবাসীদের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মতো। কলাবাগান ঝরনাস্থল এখন যেন আনন্দ-উৎসবের ফোয়ারা। রাঙামাটি শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে হলেও গাড়ি থেকে নেমে ছড়ার পথে হাঁটতে হয় আরও চার কিলোমিটার। কিছুটা সামনে এগোলেই দেখা মেলে ঝরনার স্বচ্ছ জল। অসংখ্য ছোট-বড় পাথরের গা ঘেঁষে ধেয়ে চলেছে স্রোতধারা। এ ঝরনার শীতলতায় প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠেন পর্যটকরা। দূর হয়ে যায় সব ক্লান্তি। ঝরনার পানিতে গা ভিজিয়ে আনন্দে হারিয়ে যান ভ্রমণপিপাসু নারী-পুরুষ। প্রায় প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের পদভারে মুখরিত থাকে ঝরনা স্পটটি। ঝরনা ঘুরে এসে স্থানীয় পর্যটক মো. তাজুল ইসলাম জানান, ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও পাহাড়ি ঝরনা ঘিরে এখনো গড়ে ওঠেনি কোনো পর্যটন কেন্দ্র। পর্যটকরা বলছেন, এ ঝরনা রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে এটিকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে রাঙামাটির সম্ভাবনাময় অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। রাঙামাটি পর্যটন কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপক সৃজন বিকাশ বড়ুয়া জানান, রাঙামাটির বিভিন্ন পাহাড়ে ছাট-বড় অসংখ্য ঝরনা রয়েছে, যা সত্যি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এসব ঝরনা রক্ষণাবেক্ষণ করা খুবই প্রয়োজন। কারণ অপরিকল্পিত বৃক্ষনিধনের ফলে পাহাড়ের মূল আকর্ষণ শুভলং ঝরনা মরতে বসেছে। এ কারণে শুষ্ক মৌসুমে শুভলং ঝরনায় পর্যটক কমে যায়।
Leave a Reply