বর্তমান দুরবস্থা কাটিয়ে ভবিষ্যতের জন্য বিমানকে টিকিয়ে রাখা এবং শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে আমার নিচের প্রস্তাবগুলো ভেবে দেখা যেতে পারে- এক. বিমানকে প্রাইভেট একটি সংস্থায় রূপান্তর করা। বাংলাদেশে বসে যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মসাৎ করা জনগণের অর্থ পাচার করছেন, তারা সেই অর্থ দিয়ে বিমানের শেয়ার কিনতে পারেন চলমান লন্ডন-সিলেট ফ্লাইট নিয়ে এ নিবন্ধের অবতারণা। 
বিমানের হঠাৎ করে ফ্লাইট বাতিল নিয়ে গত সপ্তাহে সাপ্তাহিক পত্রিকাসহ ব্রিটেনের সবক’টি বাংলা মিডিয়ায় গুরুত্ব সহকারে রিপোর্ট প্রকাশ ও প্রচারিত হয়েছে। এসব রিপোর্টের পর তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় ব্রিটেনে। কিন্তু এত বিরূপ প্রতিক্রিয়ার পরও বিমান কর্তৃপক্ষ তাদের এনআরবিবিরোধী সিদ্ধান্ত জায়েজ করতে সক্রিয় রয়েছে। বিমানের এক কর্মকর্তা দাবি করেছেন, করোনা আক্রান্ত যাত্রীদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার ব্যবস্থা থাকা ছাড়া আর কোথাও নেই বলেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি আরও দাবি করেছেন- এই সিদ্ধান্ত উচ্চপর্যায় থেকে নেওয়া হয়েছে। আমি বলতে চাই, যারা এসব কথা বলেন কিংবা আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন, তাদের অন্তত এটুকু বোধ থাকা উচিত যে, বিলাতবাসী বাংলাদেশের নাগরিকরা বোকা নন। প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশ থেকে যাওয়া যাত্রীদের ঢাকায় কেন কোয়ারেন্টাইন করতে হবে? আমি যতটুকু জানি, ঢাকার ভিড় এবং রাস্তাঘাটে যানজটের তুলনায় সিলেট এবং চট্টগ্রামে কোয়ারেন্টাইনের জন্য ঘরবাড়ি-ইমারত এবং খোলা জায়গার পরিমাণ অনেক বেশি। লন্ডন-সিলেট সরাসরি ফ্লাইট বাতিলের খবরে বিলাতের কমিউনিটিতে যখন তোলপাড় চলছে, তখনই খবর পেলাম যাত্রীদের ওপর নতুন আরেকটি এয়ারপোর্ট ট্যাক্স চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রতি যাত্রীকে নাকি আরও ৪০ ডলার করে এখন এয়ারপোর্ট ট্যাক্স দিতে হবে। আমরা জানি না, নতুন এই বিড়ম্বনা যাত্রীদের ওপর কোন যুক্তিতে কে বা কারা চাপিয়েছেন।
গত গ্রীষ্ফ্মে বিশেষ প্রয়োজনে দেশে গিয়েছিলাম। আমার সফরসঙ্গী ছিলেন পূর্ব লন্ডনের এক সফল ব্যবসায়ী। তিনি জানালেন, গত ৩০ বছর তার সিলেটে যাওয়া হয়নি। তাই এবার ঢাকায় না নেমে বিমানের সরাসরি ফ্লাইটে জন্মস্থান সিলেটে যাবেন। এরই মধ্যে ভিনদেশি এক বন্ধু জানালেন, তিনিও এক মাসের জন্য ছুটি কাটাতে আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশ যাবেন। টাওয়ার হ্যামলেটসের বাসিন্দা আমাদের ছোটবেলার বন্ধুটি সফল একজন ব্যবসায়ী। অনর্গল সিলেটি ভাষায় কথা বলায় পারদর্শী বন্ধুটি জানালেন- তিনি এবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও বান্দরবান ঘুরে আসার জন্য দেশের বন্ধুদের কাছ থেকে দাওয়াত পেয়েছেন। বাংলাদেশে যেতে যে ট্রাভেল এজেন্সির কাছ থেকে টিকিট কাটা হলো, তার মালিক জানালেন, যে মৌসুমে আমরা ভ্রমণ করব, তখন ইকোনমি ক্লাস মোটামুটি খালি যাবে এবং আমরা ঘুমিয়ে সিলেট যেতে পারব। পরামর্শ দিলেন, বিজনেস ক্লাসে ভ্রমণের প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশ যাওয়ার সময় আমরা ‘আকাশের নীড়ে’ চড়ে জন্মভূমিতে ঠিকমতো পৌঁছলাম। তবে লন্ডনে ফেরত আসার সময় (নভেম্বর মাস) বাজে অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছি। বিমানে যারা যাত্রীসেবার জন্য চাকরি নেন, তাদের যদি নাক এত উঁচু হয় এবং নিজেদের তারা বেশি শিক্ষিত বলে মনে করেন, তাহলে নানা কৌশল অবলম্বন করে এবং বিভিন্ন জায়গায় ধরনা দিয়ে এই চাকরিতে কেন আসবেন? বিমানবন্দরটি এখনও শুধু নামেই আন্তর্জাতিক। দুই যুগ ধরে নানা অজুহাত (রানওয়ে ছোট, ভারত তার দেশের ওপর দিয়ে বিমান উড়তে দেয় না, রিফুয়েলিং ব্যবস্থা নেই ইত্যাদি) দিয়ে বিমানবন্দরটিকে সত্যিকার অর্থে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হচ্ছে না। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জিতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর লন্ডনে এক ঘরোয়া বৈঠকে তার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎ হয়। শামসুদ্দিন খানের পূর্ব লন্ডনের অফিসে সেই সাক্ষাতে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, আমার বাবা আপনাদের ভালোবাসতেন। আমি একে একে আপনাদের সব দাবি পূরণ করব।
বিলাতের সিলেটি যাত্রীদের মর্যাদার সঙ্গে দেশ ভ্রমণ নিশ্চিত করতে সিলেটের মন্ত্রীদের ভূমিকা কী হবে, সেটিও আমাদের জানা দরকার। পাশাপাশি বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী এই প্রতিষ্ঠানটির মানোন্নয়নে যাত্রীদের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া দেওয়া উচিত। লন্ডন-সিলেট সরাসরি ফ্লাইট হঠাৎ করে বন্ধ করে দেওয়ার পর অনেকেই বলছেন, বিমান বয়কট করতে হবে। এটি হবে একটি চূড়ান্ত নেতিবাচক সিদ্ধান্ত। তবে আমি মনে করি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং তার সব সম্পদ বাংলাদেশের জনগণের সম্পদ। আমরা সবাই এর অংশীদার। এর কোনো ক্ষতি হোক আমরা নিশ্চয়ই তা চাই না। আমরা বিমানের ফ্লাইটে যেমন মর্যাদাপূর্ণ আচরণ প্রত্যাশা করি, তেমনি ওসমানী আন্তর্জাতিক এয়ারপোর্টে সত্যিকারের আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন যাত্রীসেবা চাই। আমরা চাই, সরকার এবং সংশ্নিষ্ট প্রশাসন বিমান এবং এর সঙ্গে জড়িত অসাধু চক্রের সিন্ডিকেটকে প্রতিহত করে লন্ডন-সিলেট-লন্ডন রুটে সরাসরি সার্ভিস অবিলম্বে শুরু করবে। আমরা লন্ডন থেকে সিলেট যাওয়ার পথে কিংবা সিলেট থেকে লন্ডন ফেরার পথে ঢাকায় বাড়তি বিড়ম্বনা এবং হয়রানির শিকার হতে চাই না। বর্তমান দুরবস্থা কাটিয়ে ভবিষ্যতের জন্য বিমানকে টিকিয়ে রাখা এবং শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে আমার নিচের প্রস্তাবগুলো ভেবে দেখা যেতে পারে- এক. বিমানকে প্রাইভেট একটি সংস্থায় রূপান্তরিত করা। বাংলাদেশে বসে যারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আত্মসাৎ করা জনগণের অর্থ পাচার করছেন তারা সেই অর্থ দিয়ে বিমানের শেয়ার কিনতে পারেন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ (সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ইত্যাদি) রুটে আমি বিভিন্ন প্রাইভেট এয়ারলাইন্সে ভ্রমণ করেছি। তাদের সেবার মান আমার কাছে খারাপ মনে হয়নি। আর এই অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতা মোকাবিলা করতে গিয়ে বিমানের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের সেবাও ভালো হয়েছে।

দুই. সিলেট এবং চট্টগ্রাম থেকে অন্য এয়ারলাইন্সগুলোকেও ফ্লাইট চালুর অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে মুক্তবাজারের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে বিমানও বাধ্য হয়ে তাদের সেবার মান গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসবে। আর তা না পারলে বিমান প্রতিযোগিতায় হারবে। এক্ষেত্রে যাত্রীরা সেবার মান বিবেচনা করে তাদের পছন্দের এয়ারলাইন্স বেছে নিতে পারবেন। বিদেশের এয়ারলাইন্সগুলোকে সিলেট এবং চট্টগ্রাম বিমানবন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিলে তা থেকে আয়ের নতুন পথ খুলবে। আমরা জানি, প্রতিবেশী ভারতের সিলেট সংলগ্ন সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলো সিলেট ওসমানী বিমানবন্দর ব্যবহার করতে আগ্রহী। কেউ কেউ মনে করেন, ভারতকে এই খাতে সুবিধা দেওয়া উচিত নয়। তবে আমার মতে, অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের উচিত ভারতকেও এই খাতে সুযোগ দেওয়া। কারণ ভারতের সঙ্গে আমাদের অন্যান্য বহু ব্যবসা চলছে। প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন এবং বাঁধ প্রকল্প নিয়ে আমাদের একাধিক অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। আমি মনে করি, ওসমানী বিমানবন্দর ব্যবহারের সুবিধা দিয়ে সেই অমীমাংসিত বিষয়গুলো আমরা আলোচনার টেবিলে আনতে পারি। আমরা যদি ব্যবসা জানি, তাহলে কেউ আমাদের ঠকাতে পারবে না। লন্ডন-সিলেট সরাসরি ফ্লাইট বন্ধে বিমানের সাম্প্রতিক অগ্রহণযোগ্য সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রবাসীদের মধ্যে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। যুক্তরাজ্যের বাংলা পত্রপত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় এটি স্পষ্ট। করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে গুরুতর সংকটে পড়া এয়ারলাইন্সগুলো এ পরিস্থিতি থেকে উদ্ধারে প্রাণপণ চেষ্টা করছে। অথচ বাংলাদেশ বিমান লন্ডন-সিলেট রুটে অন্যান্য এয়ারলাইন্স থেকে এই সংকটকালেও দ্বিগুণ ভাড়া ধার্য করেছে। উদাহরণস্বরূপ, কাতার এয়ারলাইন্সের ভাড়া যেখানে ৭০০ পাউন্ডের মতো, সেখানে বিমানের ভাড়া প্রায় ১৪০০ পাউন্ড। আন্তর্জাতিক বাজারে এটি মোটেও প্রতিযোগিতামূলক মূল্য হতে পারে না। এ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন করেছেন, বিমান এই কঠিন সময়ে ভাড়া দ্বিগুণ করে যাত্রীদের আরেক দফা হয়রানি করতে চায় নাকি বিমানের ভাড়া দ্বিগুণ করে এর ব্যবসা নষ্ট করতে কোনো কুচক্রী মহল পাঁয়তারায় লিপ্ত? লন্ডন-সিলেট রুটে অবিলম্বে সরাসরি ফ্লাইট চালু এবং ভাড়া গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসতে প্রবাসীদের আবার প্রধানমন্ত্রীর দ্বারস্থ হতে হবে না বলেই আশা করি।
ব্রিটেনের রাজনীতিবিদ ও কলামিস্ট। টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলের সাবেক ডেপুটি লিডার
Leave a Reply