প্রশ্ন : ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে জাহাজ রপ্তানি তার আগের অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে। কয়েক বছর ধরে জাহাজ রপ্তানিতে এক ধরনের স্থবিরতা ছিল। সাম্প্রতিক বৃদ্ধির কারণ কী?
সাইফুল ইসলাম :২০০৮ সালে বাংলাদেশ থেকে প্রথম জাহাজ রপ্তানি হয়। জার্মানিতে জাহাজ রপ্তানির ফলে বৈশ্বিকভাবে বাংলাদেশ সম্পর্কে এমন একটা বার্তা যায় যে, দেশটি বিশেষায়িত এই শিল্পে দক্ষতা অর্জন করেছে। এতে দেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়। কিন্তু ওই বছরে শুরু হওয়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং ২০১০ সালে ইউরো জোনের মন্দার কারণে সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানো যায়নি। কারণ সমুদ্রগামী জাহাজের ৭০ ভাগের মালিকানা ইউরোপের দেশগুলোর। ওই সময়ে ইউরোপের ব্যাংকগুলো জাহাজ কেনায় অর্থায়ন বন্ধ রাখে। জাহাজ ভাড়াও ৭৫ শতাংশ কমে যায়। ফলে যে সময় জাহাজ রপ্তানি ‘টেক অফ’ করবে, সেই সময় এ রকম একটা ধাক্কা এলো। সম্প্রতি আবার জাহাজ রপ্তানি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। এ বছরের শুরুতে ভারতের জিন্দাল স্টিল ওয়ার্কস চারটি আট হাজার টনের জাহাজ নিয়েছে। জাহাজ রপ্তানির ফলে প্রমাণিত হয়েছে, বাংলাদেশ শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যই উৎপাদন করে তা নয়, উচ্চ প্রযুক্তির ভারী শিল্পপণ্যও এখানে তৈরি হচ্ছে। জার্মানি, ডেনমার্ক, নিউজিল্যান্ড, কেনিয়া, পাকিস্তান ও ভারতে ইতোমধ্যে জাহাজ রপ্তানি হয়েছে। এসব জাহাজের মধ্যে পণ্যবাহী জাহাজের পাশাপাশি যাত্রীবাহী, বহুমুখী ব্যবহারের উপযোগী, মাছ ধরার জাহাজ এবং যুদ্ধজাহাজ রয়েছে।
প্রশ্ন : রপ্তানি আরও বাড়াতে করণীয় কী?
সাইফুল ইসলাম :বাংলাদেশের মার্কেটিংয়ে ঘাটতি আছে। ব্যবসায়ীরা নিজেরা যা করেন তা পর্যাপ্ত নয়। ভারত তাদের তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতের দক্ষতা মার্কেটিং করে বিশ্ববাজারে উঠে গেছে। ওই রকম মার্কেটিং করতে হবে। এ ছাড়া সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সম্মিলিত উদ্যোগ দরকার।
প্রশ্ন : সরকার কীভাবে এই খাতের সঙ্গে অংশীদারিত্বে আসতে পারে?
সাইফুল ইসলাম :সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) অনেক কাজ হচ্ছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর তিনটি শিপইয়ার্ড রয়েছে। একটি নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে বেসরকারি খাতের সঙ্গে নেভি অংশীদারিত্বে কাজ করতে পারে। বিশ্বে অফশোর পেট্রল ভেসেলের (ওপিভি) চাহিদা রয়েছে। বাংলাদেশও কেনিয়াতে একটি ওপিভি রপ্তানি করেছে। এই সুযোগ নেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা, যুদ্ধজাহাজ এবং বাণিজ্যিক জাহাজ যৌথভাবে নির্মাণ করা যেতে পারে।
প্রশ্ন : বিশ্ববাজারে কোন ধরনের জাহাজের চাহিদা বেশি এবং সেই ধরনের জাহাজ নির্মাণের দক্ষ জনবল বাংলাদেশের রয়েছে?
সাইফুল ইসলাম :বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত ছোট ও মাঝারি মানের সমুদ্রগামী জাহাজ তৈরি করে। বিশ্বব্যাপী এ ধরনের জাহাজের চাহিদা বেশি, যার বাজার ২৫০ বিলিয়ন ডলারের মতো। বাংলাদেশে যে ১০টি শিপইয়ার্ড রয়েছে তারা অবশ্যই আগামী তিন বছরে এক বিলিয়ন ডলার মূল্যের জাহাজ রপ্তানির সক্ষমতা রাখে। উন্নত প্রযুক্তির জাহাজ নির্মাণের দক্ষ জনবল দেশে রয়েছে।
প্রশ্ন : জাহাজ নির্মাণ শিল্পের সম্ভাবনা কতটুকু?
সাইফুল ইসলাম :স্থানীয় পর্যায়ে নৌপথে পণ্য পরিবহন বাড়ছে। সম্প্রতি সরকার বিভিন্ন নদীতে ড্রেজিং করছে। এই ড্রেজিং অব্যাহত থাকলে অর্থাৎ, নদীর নাব্য থাকলে অভ্যন্তরীণ নৌপথে পণ্য পরিবহন ও ভ্রমণ বাড়বে। ফলে জাহাজের চাহিদাও বাড়বে। ভারতের সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নৌ প্রটোকল এবং কোস্টাল শিপিং এগ্রিমেন্ট আগের তুলনায় বেশি কার্যকর এবং নতুন কয়েকটি রুট যুক্ত করে এর ব্যাপ্তি বাড়ানো হয়েছে। ভিয়েতনামের সঙ্গে সমুদ্রপথে যোগাযোগ শুরু হয়েছে। সামগ্রিক বাণিজ্য বাড়বে। ফলে জাহাজের চাহিদাও বাড়বে। এ ছাড়া বিশ্ববাজারেও বাণিজ্য বাড়ছে। সব মিলিয়ে জাহাজের চাহিদা বাড়ছে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশ কী সমুদ্রের নিচের খনিজসম্পদ আহরণ, সামুদ্রিক পর্যটন, সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও গবেষণা উপযোগী জাহাজ নির্মাণে প্রস্তুত?
সাইফুল ইসলাম :যে কোনো ধরনের উচ্চ প্রযুক্তির জাহাজ নির্মাণের সক্ষমতা বাংলাদেশের রয়েছে। আমাদের আড়াই হাজার টন ধারণক্ষমতার উচ্চ প্রযুক্তির ট্রলার বানানোর সক্ষমতা রয়েছে, যা গভীর সমুদ্র থেকে মাছ ধরার জন্য উপযুক্ত। এ ছাড়া সমুদ্রের গবেষণা করার উপযোগী জাহাজও আমরা তৈরি করতে সক্ষম।
প্রশ্ন : এ শিল্পের জন্য কী ধরনের নীতি সহায়তা দরকার?
সাইফুল ইসলাম :অন্যান্য খাতের তুলনায় জাহাজ নির্মাণ একটু ভিন্ন। একটি জাহাজ নির্মাণে দেড় থেকে দুই বছর সময় লাগে। ফলে প্রথমেই দরকার কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি তহবিল। এ খাতের জন্য নীতিমালা দরকার। শিল্প মন্ত্রণালয় এক বছরের বেশি সময় ধরে নীতিমালার খসড়া তৈরি করেছে। আমরা চাই দ্রুত নীতিমালা চূড়ান্ত করে কার্যকর করা হোক।
প্রশ্ন : করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ববাণিজ্য অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। জাহাজ নির্মাণ শিল্পে এর কোনো প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন?
সাইফুল ইসলাম :মানুষ মৌলিক বিষয় ছাড়া জীবনযাপন করতে পারবে না। ফলে করোনাভাইরাসের বিস্তার কমে এলে কিন্তু চাহিদা বাড়বে। তখন পণ্য পরিবহনও বাড়বে। ফলে নতুন জাহাজের চাহিদা তৈরি হবে। এ ছাড়া বর্তমানে বিশ্ববাণিজ্যে এক ধরনের পরিবর্তন আসছে। ধনী দেশগুলো এক দেশের ওপর নির্ভরতা থেকে সরে আসছে। সেজন্যও এ খাতে সুযোগ তৈরি হবে। চীন থেকে অনেক দেশ পণ্য নেওয়া বন্ধ করবে। যদিও তা রাতারাতি সম্ভব নয়। এতে অন্যান্য দেশের জন্য সুযোগ তৈরি হবে।
প্রশ্ন : রপ্তানি উপযোগী জাহাজ নির্মাণে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্প গড়ে ওঠার সম্ভাবনা কেমন?
সাইফুল ইসলাম :সব কাঁচামালই আমদানি করতে হয়। মূলত জাহাজের ক্রেতারা একটি মেকার লিস্ট দেন। সেখানে উল্লেখ খাতে কোথায় কোন ধরনের মেশিনারিসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। সে অনুযায়ী জাহাজ নির্মাণ করা হয়। তবে স্টিল, বৈদ্যুতিক তার, আসবাবপত্র, ইলেকট্রিক প্যানেল, রং ও স্যানিটারি পণ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে দেশেই ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ শিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে একটি জাহাজের মূল্যের ৪০ শতাংশ মূল্য সংযোজন হয়। এসব কাঁচামাল স্থানীয় বাজার থেকে নেওয়া গেলে মূল্য সংযোজন আরও ২০ শতাংশ বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। সূত্র : সমকাল।
Leave a Reply