গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেছেন, দেশে বাসচালকদের যারা নিয়ন্ত্রণ করবেন তারাই ক্ষমতাহীন। বাস মালিক-চালকরা যে অনিয়ম করছেন তার নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএর নেই। গতকাল সন্ধ্যায় টেলিফোনে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এই শিক্ষক।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চলছে না। কথা রাখেননি বাস মালিক-শ্রমিকরা। গাবতলী থেকে তোলা।
অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, বাস মালিক ও চালকদের অনিয়ম সংক্রান্ত সমস্যাটি অত্যন্ত জটিল। কিন্তু বাংলাদেশে যারাই এ সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের দায়িত্বে আছেন তারা সমস্যাটিকে জাতি বা সরকারের সামনে তুলে ধরছেন না। সংশ্লিষ্ট কিছু মানুষ বাসচালকদের প্রতি হুঙ্কার দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন যে, তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে ফেলবেন। কিন্তু তারা এটি পারবেন না। এখানে চালকরা যেহেতু সংঘবদ্ধভাবে ব্যবসা করছেন তাই মালিকরাও চালকদের সঙ্গে পেরে উঠছেন না। আমাদের এখানে বাসচালকদের নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বে যারা আছেন তারাই ক্ষমতাহীন, তারা আগেও বাসচালকদের অনিয়মের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারেননি, এখনো পারবেন না। তিনি বলেন, সরকারের হিসাবে দেশে সিটিং সার্ভিস বলে কোনো সেবা নেই। এখানে বাস ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কিলোমিটার হিসেবে। আর সেভাবেই শহর এলাকায় সব বাস চলবে। কিন্তু গত ১৫-২০ বছরে এই ভাড়ায় বাস চালাতে গিয়ে অসুবিধা হচ্ছে এই যুক্তিতে বাস-মালিক ও চালকরা নিজেরাই বিরতিহীন, গেটলক, সিটিং সার্ভিস ব্যবস্থা চালু করে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় শুরু করে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) আইনের আওতার বাইরে গিয়ে বাস মালিক-চালকরা যে অনিয়ম করছেন তার নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতা এই প্রতিষ্ঠানটির নেই। এরই মধ্যে বাস মালিক ও চালকরাও বুঝে ফেলেছেন যে, সরকার তার সিদ্ধান্ত নেবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভিত্তিতেই আর বাকিটা চালক-মালিকরা নিজেরাই করবেন। যদি সরকারের চাপে এদের বিরুদ্ধে হার্ডলাইনেও কিছু করা হয় তবে শুধু একটি ঝটিকা অভিযান হবে আর অভিযান পরিচালনা করার দিনগুলোতে বাসচালকরা কোনো সেবাও দেবেন না। তখন জনদুর্ভোগ দেখে সরকার আবার নমনীয় হয়ে পড়বে। এই বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আরও বলেন, আমাদের এখানে রেগুলেটরি অথরিটির যে সক্ষমতা থাকার কথা তা নেই। আমি জানি না ১ সেপ্টেম্বর (গতকাল) বিআরটিএ কীভাবে সর্বসাকল্যে মাত্র ১২ জন ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে শহরের বাসচালকদের অনিয়ম নজরদারি করার কথা ভেবেছেন। আবার সংস্থাটি হুঁশিয়ারিও দিচ্ছে। কিন্তু হুঁশিয়ারি দিতে হলেও তো তাদের লজিস্টিক সাপোর্ট কতটা আছে তা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। চালকরাও বুঝে গেছেন, এই স্বল্প সংখ্যক ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে শুধু মানিক মিয়া এভিনিউতেই অভিযান চালানো সম্ভব। কিন্তু ঢাকা শুধু মানিক মিয়া এভিনিউর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এত বড় শহরের রাস্তার নেটওয়ার্কও বড়, সেখানে শুধু ১২ জন ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে দায়িত্ব পালন সম্ভব নয়। অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, ২০-২৫ বছর ধরেই এ সমস্যাগুলো তৈরি হয়েছে। এটি সমাধানের জন্য ২০০৫ সাল থেকে একটি দাওয়াই দেওয়া আছে। আর এটি প্রয়োগ করা হলে ঢাকার বাস রুটে দৃশ্যমান উন্নতি হবে। সেই দাওয়াইটি হলো, বাস রুট ফেঞ্চাইজি। ঢাকার গুলশান চাকা এবং হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস সার্ভিসের মতো বাস সেবা দেওয়া। এই ব্যবস্থায় চালকরা ব্যবসা করেন না। কারণ, তারা বেতনভুক্ত। আবার এদের নজরদারি করার জন্য ‘ওয়াচডগও’ থাকতে হবে। তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ২০১৩ সালেও ১৫৬টি বাসকে ২২টি করিডোরে নিয়ে এসে পাঁচটি কোম্পানির মাধ্যমে পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছিল। ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র আনিসুল হক এই সেবা দেওয়ার জন্য চেষ্টাও করেছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে এসে বাস মালিক-চালকদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। রমিজউদ্দিন স্কুলের শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা দক্ষিণের তৎকালীন মেয়রকেও এই সেবা ব্যবস্থা চালুর জন্য দায়িত্ব দেন। কিন্তু পরে তিনিও পেরে ওঠেননি। আমাদের বুঝতে হবে, সিস্টেমের পরিকল্পনার মধ্যেই গ-গোল আছে। এর সমাধানে কোনো বিনিয়োগ লাগবে না। শুধু রাজনৈতিক প্রণোদনা ও পলিসি রিফর্ম করা প্রয়োজন। এমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, এক করিডরে একটি কোম্পানির বেশি বাস চালাতে দেওয়া যাবে না। তাহলেই এ খাতে সবকিছু সুশৃঙ্খল হয়ে যাবে।
তিনি আরও বলেন, গণপরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে সবার আগে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ জন্য সরকারকে যথেষ্ট পরিমাণ প্রচারণা চালাতে হবে, যাতে মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে মাস্ক পরায় আগ্রহী হয়। সরকারকে এ জন্য বাস মালিকদের সঙ্গে বসে প্রটোকল তৈরি করতে হবে। কারণ, মালিকরা বিআরটিএ ও মেয়র কারও কথাই শুনবেন না। এখানে সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ থেকে মালিকদের বোঝাতে হবে, আমরা করোনার ঝুঁকিতে আছি। তাদের বোঝাতে হবে তারা যেন বাসে সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে চলেন।
Leave a Reply