করোনা পরিস্থিতিতেও থেমে নেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনালের নির্মাণকাজ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেড় হাজার শ্রমিকের দিন-রাত পরিশ্রমে দৃশ্যমান হচ্ছে দেশের অন্যতম এই মেগা প্রকল্প। প্রায় ৩৫০ একর জমির ওপর নির্মাণাধীন টার্মিনালে একসঙ্গে কতগুলো ফ্লাইট বোর্ডিং ব্রিজ, ইমিগ্রেশন কতটা আধুনিক ও যানজট মোকাবিলার সুযোগ-সুবিধা থাকবে তা নিয়ে কৌতূহলী জবাব দেন বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, থার্ড টার্মিনাল বর্তমান টার্মিনাল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
থার্ড টার্মিনালে কেবিন এক্সরে মেশিন ৪০টি, বোর্ডিং ব্রিজ ১২টি, কনভেয়ার বেল্ট ১৬টি, বডি স্ক্যানার ১১টি, টানেলসহ বহুতলবিশিষ্ট কার পার্কিং ৫৪ হাজার বর্গমিটার, নতুন ইমপোর্ট কার্গো কমপ্লেক্স ও এক্সপোর্ট কার্গো কমপ্লেক্স ৬৩ হাজার বর্গমিটার, রেসকিউ ও ফায়ার ফাইটিং স্টেশন এবং ইক্যুইপমেন্ট ৪ হাজার বর্গমিটার, ভূমি উন্নয়ন, কানেক্টিং ট্যাক্সিওয়ে (উত্তর) ২৪ হাজার বর্গামিটার, কানেক্টিং ট্যাক্সিওয়ে (অন্যান্য) ৪২ হাজার ৫০০ বর্গমিটার, র্যাপিড এক্সিট ট্যাক্সিওয়ে (উত্তর) ২২ হাজার বর্গামিটার, র্যাপিড এক্সিট ট্যাক্সিওয়ে (দক্ষিণ) ১৯ হাজার ৫০০ বর্গমিটার, সোল্ডার ৯৬ হাজার ৫০০ বর্গমিটার, জিএসই রোড ৮৩ হাজার ৮০০ বর্গমিটার, সার্ভিস রোড ৩৩ হাজার বর্গমিটার, ড্রেনেজ ওয়ার্কস (বক্স কালভার্ট ও প্রোটেক্টিভ ওয়ার্কস), বাউন্ডারি ওয়াল, সিকিউরিটি গেট, গার্ড রুম ও ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ, ল্যান্ড সাইড, সার্ভিস রোডসহ এলিভেটেড রোড, ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেম, স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, ইনটেক পাওয়ার প্লান্ট ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, কার্গো কমপ্লেক্সের জন্য সিকিউরিটি ও টার্মিনাল ইক্যুইপমেন্ট, এয়ারফিল্ড গ্রাউন্ড লাইটিং সিস্টেম, হাইড্রেন্ট ফুয়েল সিস্টেমসহ আনুষঙ্গিক সব সুবিধা থাকবে। এ ছাড়া অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে ফানেল টানেল রাখা হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ৫ লাখ ৪২ হাজার বর্গমিটারে ৩৭টি উড়োজাহাজ রাখার অ্যাপ্রোন ও ১ হাজার ২৩০টি গাড়ি রাখার সুবিধা, ৬৩ হাজার বর্গফুট জায়গায় আমদানি-রপ্তানি কার্গো কমপ্লেক্স, ১১৫টি চেক-থার্ড টার্মিনাল ইন কাউন্টার সব মিলিয়ে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিমানবন্দরের সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে থার্ড টার্মিনালে। ২০১৯ সালের শেষে শুরু হওয়া নির্মাণকাজ শেষ হবে ২০২৩ সালের জুনে। ২০১৭ সালের ২৪ অক্টোবর শাহজালাল বিমানবন্দর সম্প্রসারণে এই প্রকল্পের অনুমোদন দেয় একনেক। প্রথমে ১৩ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ধরা হলে পরে প্রকল্প ব্যয় ৭ হাজার ৭৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়। নির্মাণকাজে অর্থায়ন করছে জাইকা। আর জাপানের সিমুজি ও কোরিয়ার স্যামসাং যৌথভাবে এভিয়েশন ঢাকা কনসোর্টিয়াম (এডিসি) নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। দুই দেশের চার শতাধিক দক্ষ জনবল কাজ করছেন। প্রখ্যাত স্থপতি রোহানি বাহারিনের নকশায় টার্মিনালে ২ লাখ ৩০ হাজার বর্গমিটার আয়তনের একটি ভবন তৈরি হবে।
প্রকল্প পরিচালক বেবিচকের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাকসুদুল ইসলাম বলেন, ‘বিশাল প্রকল্পে ত্রুটি এড়াতে সবাই সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে কাজ করছেন। বেবিচক চেয়ারম্যান সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন। প্রতি সপ্তাহে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ডেকে কাজের অগ্রগতি নিচ্ছেন, অসঙ্গতি পেলে পরামর্শ দিচ্ছেন। এজন্য করোনাও আমাদের কাজে বাধা হতে পারেনি।’
বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মফিদুর রহমান বলেন, ‘থার্ড টার্মিনাল দেশের অন্যতম অগ্রাধিকার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্নের প্রকল্প। বিষয়টি মনে রেখেই আমাদের সবাইকে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ শেষ হবে। বিশ্বের দৃষ্টিনন্দন ও অত্যাধুনিক বিমানবন্দরগুলোর মধ্যে একটি হবে শাহজালাল। যাত্রীদের দুর্ভোগ অনেকাংশে কমে আসবে। পাশাপাশি এই বিমানবন্দর দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনা মহামারীতে বিশ্বে সবকিছু থমকে দাঁড়ালেও আমাদের প্রকল্প চলছে। শুরুর দিকে হোঁচট খেলেও বেবিচক শ্রমিক থেকে কর্মকর্তা সবার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রেখে বিকল্প পন্থায় স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ এগিয়ে নিচ্ছে।’
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে দেখা যায়, বৃষ্টি আর কাদার মধ্যেও পুরোদমে চলছে পাইলিংয়ের কাজ। প্রায় ৩ হাজার পাইলিংয়ের মধ্যে ৭০০টি শেষ হয়েছে। পাইলিংসহ টার্মিনালের ৮ শতাংশ কাজ হয়েছে। থার্ড টার্মিনাল ভবনে বহির্গমনের (ডিপারচার) জন্য ১৫টি সেলফ চেক-ইন (স্ব-সেবা) কাউন্টারসহ মোট ১১৫টি চেক-ইন কাউন্টার থাকবে। বহির্গমনে ৬৪ ও আগমনী যাত্রীদের জন্য থাকবে ৬৪ ইমিগ্রেশন কাউন্টার। এ ছাড়া ২৭টি ব্যাগেজ স্ক্যানিং মেশিন, ১১টি বডি স্ক্যানার, ১২টি বোর্ডিং ব্রিজ ও ১৬টি লাগেজ বেল্ট থাকবে। বর্তমানে ভিভিআইপিদের জন্য শাহজালালে পৃথক কমপ্লেক্স রয়েছে। থার্ড টার্মিনাল ভবনের ভেতরে কমপ্লেক্সের পরিবর্তে স্পেস রাখার কথা ছিল। তবে প্রকল্পের কিছু টাকা উদ্বৃত্ত থাকবে বিধায় ভিভিআইপি কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে। স্বাভাবিক সময়ে শাহজালালে দিনে ১৩০টি অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ২৫ থেকে ৩০ হাজার যাত্রী যাতায়াত করেন। বর্তমানে বিমানবন্দর বছরে ৮০ লাখ যাত্রী হ্যান্ডেল করতে সক্ষম। থার্ড টার্মিনাল হলে হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বেড়ে ২ কোটিতে ঠেকবে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, ‘নির্মাণ স্থানে মাটির অবস্থার কারণে স্ক্রুড পাইলিংয়ের পরিবর্তে বোর পাইলিং করা হচ্ছে। এজন্য প্রকল্প ব্যয় থেকে ৭৫০ কোটি টাকা সাশ্রয় হতে পারে। এই অর্থে সরকার ও জাইকার সম্মতি এবং অন্যান্য বিধিগত প্রক্রিয়া নিষ্পত্তি সাপেক্ষে থার্ড টার্মিনালে ১২টি বোর্ডিং ব্রিজের অতিরিক্ত আরও ১৪টি বোর্ডিং ব্রিজ এবং একটি ভিভিআইপি টার্মিনাল কমপ্লেক্স নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যেই নির্মাণকাজ শেষ করে তা যাত্রীদের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করা সম্ভব হবে।’
বেবিচকের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রকল্পের ভেতরে একটি প্রাথমিক চিকিৎসা ইউনিট রয়েছে। করোনা সংক্রমণের কারণে সবাইকে মাস্ক ও সুরক্ষাসামগ্রী নিশ্চিত করে কাজ করতে হয়। ঢাকার দুটি হাসপাতালের সঙ্গে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার চুক্তি থাকায় আক্রান্তরা দ্রুত চিকিৎসাসেবা পেয়েছেন। তারা সুস্থ হয়ে আবার কাজে ফিরেছেন। করোনা সংকট না এলে এতদিন দৃশ্যমান অগ্রগতি হতো।’
বেবিচকের প্রধান প্রকৌশলী আবদুল মালেক বলেন, ‘এ ধরনের প্রকল্পে মাটি ও বালু ভরাট সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। বর্ষার আগেই টার্মিনাল ভবনের মূল ভিত্তিতে মাটি ও বালু ভরাট হয়ে গেছে। ৫ কোটি ঘনফুটের মধ্যে ২ কোটি ঘনফুট বালু ও মাটি আনা হয়েছে। মেঘনার দাউদকান্দি থেকে বালু এনে পাহাড় গড়া হচ্ছে। ৭০০ পাইলিং নির্মাণ হয়েছে। বাকিগুলোও বছরখানেকের মধ্যে হয়ে যাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এ প্রকল্পে অনেকগুলো স্থাপনা রয়েছে। এর মধ্যে মূল ও প্রধান হচ্ছে টার্মিনাল ভবন। এখানেই পাইলিং হবে ৩ হাজার। বাকি স্থাপনাগুলোয় হবে আরও প্রায় ৪ হাজার।’
Leave a Reply