কোভিড-১৯ এর সঠিক রোগতত্ত্ব ও ইতিহাস বোঝার জন্য রোগসম্পর্কিত সঠিক তথ্য-উপাত্ত প্রয়োজন। রোগতাত্ত্বিক প্রোফাইল তৈরির ক্ষেত্রে সেরো পজিটিভ কেস, ইভালুয়েশন অব এক্সপোজার এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং গুরুত্বপূর্ণ। তবে বিপুল জনসংখ্যার ক্ষেত্রে এসব তথ্য সংগ্রহ বেশ কষ্টসাধ্য। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ করোনা রোগের ডিজিজ ইন্সিডেন্স ও এটা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছে। তবে এর সঙ্গে আরও একটি বিষয়ের ওপর বিশেষভাবে নজর দেওয়া প্রয়োজন, যা হলো মৃত্যুর হার, কেননা দেখা যাচ্ছে কোথাও কোথাও আক্রান্তের সংখ্যা কমে এলেও করোনার কারণে মৃত্যুসংখ্যা কমানো যাচ্ছে না বরং দিন দিন মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর এই মৃত্যুর হার ও কারণ পর্যালোচনার সর্বোত্তম পদ্ধতি হলো মর্টালিটি অডিট।
মর্টালিটি অডিট হচ্ছে, কোনো নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কারণে ঘটে যাওয়া মোট মৃত্যুর সংখ্যা এবং তার সঙ্গে জড়িত কারণগুলোর লিপিবদ্ধকরণ। যাতে করে পরে এসব বিষয় পর্যালোচনা করে রোগীর সেবার মান উন্নত করা হয় এবং নির্গত ফলাফলের সঙ্গে স্বীকৃত মানের তুলনা করে ক্লিনিক্যাল ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিগত উন্নতি সাধন করা যায়। এর সাহায্যে রোগীর প্রতি সেবার গুণগত মানে কোনো ঘাটতি আছে কিনা তা জানা যায় এবং এর জন্য কী কী পরিবর্তন প্রয়োজন তা নির্ণয় করা যায়। এ ক্ষেত্রে মৃত্যুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা, বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং ক্লিনিক্যাল কেসগুলোকেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে পদক্ষেপগুলো নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা হলো- প্রথমত, বিভিন্ন দেশের কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত মৃত ব্যক্তিদের মৃত্যুসংক্রান্ত সব তথ্য একত্রিত করে সংগ্রহ করা হবে, দ্বিতীয়ত, রোগতত্ত্ববিদরা সেই কেস রেকর্ডগুলো পর্যালোচনা করবে এবং মূল ডাটার যাচাই-বাছাই করবে, তৃতীয়ত, যাচাই-বাছাইকৃত তথ্যগুলো অনুসারে স্বাস্থ্যসেবাকর্মীদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
যেসব দেশে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণ ঘটেছে তাদের মধ্যে বেশকিছু দেশ মর্টালিটি অডিটের মাধ্যমে তাদের মৃতের কারণ পর্যালোচনা করেছে। এসব দেশের মধ্যে যুক্তরাজ্য, ইতালি ও ভারত অন্যতম। ইতালির পর্যালোচনায় কোভিড-১৯ এ মৃতের প্রধান কারণগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হয়। নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত কোভিড রোগীর মধ্যে যারা মারা যাচ্ছে তাদের এই পর্যালোচনার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত থেকে রোগীর সংখ্যা, বয়স, দীর্ঘমেয়াদি রোগ (কো-মর্বিডিটি), রোগের উপসর্গ আছে কিনা তা গবেষণা করা হয়। তবে সূক্ষ্মভাবে পর্যালোচনার জন্য আরও কিছু তথ্য নিয়েও অনুসন্ধান করা হয়, যেমন- মৃত্যুর সময় এবং কোন সময়ে তাকে হাসপাতালে আনা হয়েছিল এবং ওই সময়ে রোগীর কী কী উপসর্গ ছিল। এটা ছাড়াও মৃত ব্যক্তির পর্যায়ক্রমিক চিকিৎসাব্যবস্থারও বিশ্লেষণ করা হয়। একইভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী ভারত ও যুক্তরাজ্যও তাদের মর্টালিটি অডিট করেছে।
ইতালির মৃতের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় যে, ৭০ বছরের বেশি বয়স্ক পুরুষ যাদের বিভিন্ন রকমের দীর্ঘমেয়াদি রোগ (কো-মর্বিডিটি) ছিল তাদের মৃতের সংখ্যা বেশি। যুক্তরাজ্যে কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়া ৯০ শতাংশ মানুষের বয়স ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ছিল এবং মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৬০ শতাংশই পুরুষ। সিডিসির (চায়না) এক জরিপে বলা হয়, ৪৪,৬৭২ জনের (যার মধ্যে ১,০২৩ জন মারা গিয়েছেন) মধ্যে এক গবেষণায় দেখা গিয়েছে যাদের হৃদরোগ, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্থূলতা, ফুসফুসের বিভিন্ন রোগ এবং ক্যানসার আছে তাদের মধ্যে মৃত্যুঝুঁকি বেশি।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রান্ত জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটির একটি সুপারিশে এই বিষয়টির ওপর যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তারা বলছেন, কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে রোগীর সংখ্যা কমে এলেও মৃত্যু কমছে না এবং পঞ্চাশোর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোভিড মৃতের সংখ্যা সন্দেহাতীতভাবে আশঙ্কাজনক। ধারণা করা হচ্ছে, বিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া, প্রাথমিক পর্যায়ে বয়স্ক রোগীদের করোনা উপসর্গ বা রোগ নিয়ে ঘরে বসেই চিকিৎসা নেওয়া, অসংক্রামক রোগের চিকিৎসায় অবহেলা, রোগের উপসর্গ নির্ণয় ও সেবার মানসংক্রান্ত ঘাটতি, অক্সিজেনের সরবরাহ, নমুনা পরীক্ষার অপ্রতুলতা ইত্যাদি বিবিধ বিষয় এখনো করোনা মৃত্যু রোধে বড় অন্তরায়। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ চিকিৎসা গবেষণা পরিষদ এতদসংক্রান্ত একটি গবেষণা প্রস্তাব জমা দেওয়া হয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস এবং আইইডিসিআরের সহযোগিতায় কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর অদ্যাবধি মৃত্যুর রেকর্ড বিশ্লেষণ করে এই মৃত্যুগুলোর পেছনে অন্তর্নিহিত কারণগুলো খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিলম্বে হলেও তাদের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। কারণ এই রোগতত্ত্বভিত্তিক মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বিজ্ঞানভিত্তিক সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে করোনাজনিত মৃত্যু কমিয়ে আনা সম্ভব। যেহেতু করোনা সংক্রমণের এই ধারা বেশ কিছুদিন অব্যাহত থাকার আশঙ্কা রয়েছে এবং যেহেতু একটি কার্যকরী সহজলভ্য সর্বজনীন ভ্যাকসিন আসতে বছর দেড়দুয়েক লেগে যেতে পারে তাই মৃত্যু কমানোর লক্ষ্য নিয়েই স্বাস্থ্য বিভাগকে কাজ করতে হবে।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোভিড-১৯ এর সঠিক রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও মৃত্যুর কারণ সঠিকভাবে চিহ্নিত করার জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে একত্রিত করে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। মর্টালিটি বিশ্লেষণ রোগতত্ত্বের একটি মূল্যবান ভিত্তি।
আরও সহজ করে বললে বর্তমান বিশ্বে চলমান কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবিলায় ও মৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে মর্টালিটি অডিট একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
ডা. মো. রিজওয়ানুল করিম : রোগতত্ত্ববিদ, সমন্বিত করোনা নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর
Leave a Reply