বহুল আলোচিত সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর মেগাপ্রকল্প বাতিল করা হলো। আট বছর অনিশ্চয়তায় ঘুরপাক। এরপর সরকার দেশের প্রথম স্বপ্নের গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে সরে এলো। বলা হচ্ছে সরে আসতে ‘বাধ্য’ হলো। সোনাদিয়া মেগাপ্রকল্প ভূ-রাজনীতির শিকার। চীনের সহযোগিতায় মেগাপ্রকল্পটি নিয়ে প্রথম থেকেই ভারতের আপত্তি। ভারতের আবদার পূরণ হলো। ২০১২ সালের ২ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর কর্তৃপক্ষ আইন’-এর খসড়ায় আওয়ামী লীগ সরকার নীতিগত অনুমোদন দেয়। ২০১৪ সালে এটি অগ্রাধিকারভুক্ত (ফাস্ট-ট্র্যাক) মেগাপ্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করে। আর গত ৩১ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে আগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। যা ছিল শুধুই আনুষ্ঠানিকতা। কেননা সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর বাস্তবায়ন কাজ শুরু হতে না হতেই বন্ধ রাখা হয় ভারতের আবদার ও চাপের কারণে। অবশেষে বাতিলের মধ্যদিয়ে সোনাদিয়ার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়া হলো।
অবশ্য বাতিলের যুক্তি হিসেবে মন্ত্রিসভার ওই বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, সোনাদিয়ার কাছে মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ কাজ চলছে। পাশাপাশি দু’টি বন্দর হলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে। তাছাড়া সোনাদিয়ায় সমুদ্রবন্দর হলে প্রাকৃতিক পরিবেশ, সামুদ্রিক মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য ক্ষুন্ন হবে। এটা যখন স্টাডিতে ধরা পড়ল তখন সরকার সিদ্ধান্ত নিল সোনাদিয়ায় প্রকৃতির ক্ষতি করে সমুদ্রবন্দর করার দরকার নেই। মাতারবাড়ী আরও বেশি উপযুক্ত।
ঢাকা থেকে ৩৯০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার সোনাদিয়া উপদ্বীপে গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের জন্য ২০০৫ সালে উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপর প্যাসিফিক কনসাল্টস ইন্টারন্যাশনাল ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে আর্থ-কারিগরি সমীক্ষার মাধ্যমে সমুদ্রে ৫টি স্থানের মধ্যে সোনাদিয়াকেই সবচেয়ে উপযুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করে। সেখানে প্রাকৃতিকভাবে সুগভীর খাদ বা চ্যানেল রয়েছে। এরফলে তেমন ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হতো না। যা গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য অপরিহার্য। ২০০৯ সালের মে মাসে সোনাদিয়াকে সরকার গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য চূড়ান্ত করে।
৪২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিন ধাপে ২০৫৫ সালে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে গৃহীত হয় মেগাপ্রকল্প। সেখানে চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ে ৭৪ গুণ বেশি কন্টেইনার ওঠানামার টার্গেট রাখা হয়। বঙ্গোপসাগরের কিনারে অনুকূল ভূ-প্রাকৃতিক সুবিধাজনক অবস্থান এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি, জাতীয় প্রবৃদ্ধি গতিশীল করা, প্রতিবেশী ও আঞ্চলিক দেশসমূহ বিশেষ করে ভারত, নেপাল, ভূটান, মিয়ানমার, চীন মিলিয়ে ‘হাব পোর্ট’ হিসেবে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দরের অপরিহার্যতা মেগাপ্রকল্পের গুরুত্বে তুলে ধরা হয়। বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর বার্ষিক ৩১ লাখ টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করতে গিয়ে হিমশিম অবস্থায় পড়ছে। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিগণ সোনাদিয়া প্রকল্পস্থল পরিদর্শন করেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক পর্যায়ে ভূমির অবৈধ দখল উচ্ছেদে একাধিকবার অভিযান চালায় কক্সবাজার জেলা প্রশাসন।
গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণে গোড়া থেকেই চীন অর্থায়ন ও কারিগরি সহায়তার প্রস্তাবসহ ব্যাপক বিনিয়োগে গভীর আগ্রহ দেখায়। ২০১২ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট (তখন ভাইস প্রেসিডেন্ট) শি জিনপিং বাংলাদেশ সফরকালে আলোচনা অনেক দূর অগ্রসর হয়। দুই দেশের মধ্যে কয়েক দফা চিঠি বিনিময় হয়। ২০১৪ সালের জুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের জন্য চীনের সঙ্গে ১৪ বিলিয়ন ডলারের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সম্ভাবনার কথা থাকলেও পরে তা আর হয়নি। এরমধ্যে পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের তৎপরতা শুরু হয়। ভারতও এতে আগ্রহ দেখায়। কিন্তু পায়রার গভীরতা, ভূ-প্রাকৃতিক ও হাইড্রোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্যগুলো গভীর সমুদ্রবন্দরের জন্য আদৌ উপযোগী কি না বিশেষজ্ঞ মহলে এসব প্রশ্ন ওঠে। এ অবস্থায় সরকারের সেই উদ্যোগ ‘পায়রা বন্দর’ পর্যন্ত এগিয়ে তা থেমে যায়।
বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর মেগাপ্রকল্প বাতিল প্রসঙ্গে বলেন, এরজন্য ভারত ও চীনের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থগত দ্বন্দ্বই দায়ী। ভারতের চাপেই বাতিল হলো চীনের অর্থায়নের প্রস্তাবে ৪২ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর মেগাপ্রকল্প। ভারতকে চটিয়ে তো এটা করা যাবে না, তাতে লাভও নেই। তবে আমরা বঞ্চিত হলাম। কেননা সোনাদিয়া দ্বীপের কিনারেই গভীর সমুদ্রের খাঁড়ি, খাদ বা চ্যানেল রয়েছে। স্বাভাবিক খাদ ব্যবহার করেই গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপন সহজ ছিল।
সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মিত হলে ভারতের আন্দামান-নিকোবর দ্বীপের সন্নিকটে চীনের উপস্থিতি প্রশ্নে ভারতের আপত্তি’ উল্লেখ করে বিগত ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ তারিখে ‘দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর প্রসঙ্গে ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ভারত চীনকে বঙ্গোপসাগরে আসতে দিতে চাইছে না। তবে মিয়ানমারের কিয়েকফোতে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করেছে।
এরফলে বঙ্গোপসাগরে এবং ভারতের আরও কাছেই এসে গেছে চীন। সেখান থেকে আন্দামান-নিকোবরের দূরত্ব বরং আরও কম। বঙ্গোপসাগরে চীন তার উপস্থিতির উদ্দেশ্য হাসিল করে ফেলেছে। সোনাদিয়া নিয়ে চীনের আগ্রহ আগেই দমে গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের পরিবর্তে মিয়ানমারে চীনা সহায়তায় দ্বিতীয় গভীর সমুদ্রবন্দরটি নির্মিত হলো। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার আরও বেশিমাত্রায় চীনের প্রভাব বলয়ে চলে গেছে। এরফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার চীনের সমর্থন পাচ্ছে আরও বেশি।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর : ২০১৪ সালের আগস্টে সোনাদিয়ার ২৫ কিলোমিটার দূরে মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে ১২শ’ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ৩৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন করে সরকার। ‘বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ- বিগ-বি’র আওতায় মহেশখালী-মাতারবাড়ী-ধলঘাটে জাপান, চীনসহ বিভিন্ন দেশের সহায়তায় শিল্প-বাণিজ্য, জ্বালানি, অবকাঠামো উন্নয়ন খাতের প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জাপানের অর্থায়নে এ প্রকল্পে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা-জাইকার বিশেষজ্ঞদের কারিগরি সমীক্ষায় বেরিয়ে আসে, মাতারবাড়ী এলাকাটি বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের উপযোগী। জাপানে কাশিমা এ ধরনের সমুদ্রবন্দর।
গত ১০ মার্চ মাতারবাড়ীতে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের প্রথম গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্প একনেকে অনুমোদিত হয়। প্রকল্পের ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ টাকার মধ্যে জাপানের ঋণ সহায়তা ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ টাকা। অবশিষ্ট ব্যয়ের মধ্যে সরকার ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ টাকা যোগান দিচ্ছে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পটি চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগ যৌথভাবে ২০২৬ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করবে। এ প্রকল্পে সংযোগ সড়কসহ গভীর সমুদ্রবন্দরে ৩শ’ ও ৪৬০ মিটার দীর্ঘ দু’টি টার্মিনাল নির্মাণ করা হবে। এরফলে বিশাল জাহাজে সরাসরি পণ্য ওঠানামা সহজ হবে।
মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত প্রকল্প। বৃহাদাকার (ডীপ ড্রাফট) জাহাজের জন্য জেটি-বার্থিং সুবিধা নিশ্চিত করা, আধুনিক কন্টেইনারবাহী জাহাজ, খোলা পণ্যভর্তি জাহাজ ও তেলবাহী ট্যাঙ্কারের জেটিতে ভিড়ার অবকাঠামো সুবিধা নিশ্চিত করা, চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর চাপ কমানো, দেশের ক্রমবর্ধমান আমদানি-রফতানি চাহিদা পূরণ এবং মাতারবাড়ী-মহেশখালী দ্বীপাঞ্চলে নির্মাণাধীন অর্থনৈতিক জোন, শিল্পাঞ্চল ও জ্বালানি কেন্দ্রসমূহে পণ্যসামগ্রী পরিবহনের সক্ষমতা অর্জন করাই বহুমুখী সুবিধাসম্পন্ন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর স্থাপনের মূল লক্ষ্য।
মাতারবাড়ী সমুদ্রবন্দরের চ্যানেলের গভীরতা হবে ১৮ মিটার। বার্থ-টার্মিনালে ১৬ মিটার ড্রাফটেরও বেশি এবং ৮ হাজার টিইইউএস কন্টেইনারবাহী জাহাজ ভিড়তে পারবে। সেখান থেকে ফিডার ও লাইটার জাহাজযোগে দেশের অন্যান্য বন্দরে কন্টেইনার ও খোলা পণ্য পরিবহন করা যাবে।
অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরটি সোনাদিয়ার উপযুক্ত বিকল্প। সেখানে কমবেশি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে কন্টেইনারবাহী ও অন্যান্য জাহাজ চলাচল, মুভমেন্ট ও ভিড়ার (বার্থিং) উপযোগী ১৮ মিটার গভীর চ্যানেল তৈরি হচ্ছে। জাপানী বিশেষজ্ঞদের গবেষণা ও সমীক্ষায় এটি গভীর সমুদ্রবন্দরের উপযোগী স্থান। দেশের অর্থনীতি, শিল্পায়ন ও বিনিয়োগে এ প্রকল্প আগামীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
Leave a Reply