‘শিল্পীগুরু অবনীন্দ্রনাথ’ বইয়ে লিখছেন রানী চন্দ, ‘তোমরা সব রবিকার জীবনী খুঁজছ, রবিকার গানই তো তাঁর জীবনী। … গানের মধ্যে রবিকার সারাজীবন ধরা আছে। সুর ও কথার অন্তরে তাঁর জীবন্ত ছবি ওখানেই পাবে।’ বলেছেন অবনীন্দ্রনাথ। ‘রবিকা’ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ।
বহুমানিত কবি শঙ্খ ঘোষ। রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞ। বুদ্ধিযোগী। বুদ্ধিজীবী। ‘দামিনীর গান’ প্রবন্ধ গ্রন্থে জানাচ্ছেন, ‘শিল্প থেকে শিল্পীর ব্যক্তিজীবনে পৌঁছার একটা সরল পথও যে কখনও কখনও পাওয়া যায়, সেটাও মিথ্যে নয়।’ যেহেতু মিথ্যে নয়, শিল্পীর ব্যক্তিজীবনও বহুসূত্রে ছড়ানো। অতীত এবং সমকালীন পরম্পরায় একতাবদ্ধ।
একজন কবি-সাহিত্যিক নানাভাবে নিজেকে, নিজের পারিপার্শ্বিকে, সমাজ-রাষ্ট্রে একীভূত। রাজনীতির ছোঁয়া এড়িয়েও। এড়ানোও রাজনীতি, সূক্ষ্ণ চাতুর্যে। মানুষকে, জীবনকে যে স্বরূপে সন্ধান করেন, দেখতে চান, চাওয়ার মধ্যেই নিহিত রাজনীতির বলয়।
একজন প্রজ্ঞাশীল চিত্রকর মননবোধে উদ্ভাসিত তখনই, তাঁর চিত্রশিল্পকর্মে, রঙে-রেখায়-অঙ্কনে সংযোজন করেন মানুষের বিবিধ অবয়ব, চালচলন, হরেক ভঙ্গির রূপ-অরূপ। প্রথমত, মানুষই আরাধ্য। দ্বিতীয়ত, মানুষের ভিতরকার জীবনেরও সঙ্গী। তৃতীয়ত, মানুষই উৎস। মানুষের সঙ্গে একাত্ম। খুব সহজ নয় এই চেতনা, ঐতিহ্য ধারণ। যিনি পারেন, নিশ্চিতই মহৎ শিল্পী। যেমন শাহাবুদ্দিন। কোমলে সংগ্রামী, কঠিনেও সংগ্রামী। সুখ-দুঃখেও। এখানেই রবীন্দ্রনাথের কথা, ‘যেখানে দেখছ দুঃখ ও ব্যথা- তলিয়ে দেখবে সেখান থেকেই পাবে আনন্দ।’
আমরা দেখছি মানুষের দুঃখ-ব্যথা-আনন্দ শাহাবুদ্দিনের ছবিতে মিলেমিশে একাকার। আছে বিপ্লব, আছে সংগ্রাম, আছে সঙ্গবদ্ধ জীবন। ছন্দময় জীবনের অন্তরঙ্গতা।
শাহাবুদ্দিনের একটি ছবি দেখে বিস্ময় মেনেছি। নানা মুখ। নানা মুখের মানুষ। নানা বয়সের। প্রচণ্ড গতিতে বিক্ষোভ আন্দোলনে ধাবমান। প্যারিসে, শাহাবুদ্দিনের স্টুডিওয় ঢুকে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উক্তি, ‘এই ছবি সব দেশের, সব কালের।’
সুভাষদাকে বললুম, ‘আজকের ভারতের চিত্র।’
‘সুভাষ :বাস্তিলের সংগ্রাম থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও’ সুভাষ তখন প্যারিসে, এক বিকেলে শাহাবুদ্দিনের আস্তানায়। গিয়েই, আবদার, ‘তোমার স্টুডিও দেখব।’ তখন রীতিমতন গ্রীষ্ফ্ম। ছত্রিশ ডিগ্রি গরম। পাঞ্জাবি খুলে সোফায় আসীন। গায়ে গেঞ্জি। এই দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দি করলুম।
সুভাষই বললেন, ‘তোমার ছবিতে রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী, বঙ্গবন্ধু নানাভাবে, নানা মুহূর্তকাল। অঙ্কিত। নানা মানুষেরও। ভারতের অন্য কোনো শিল্পীর ছবিতে দেখিনি। তুমি মানুষের কবি। মানুষের চিত্রী। তুমি মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধ-মানুষ-সংগ্রাম দেখেছ। এখনও দেখছ। গোটাবিশ্বে।’ সুভাষ যা বলেছিলেন, শাহাবুদ্দিনের বিলাভড স্ত্রী, সুলেখিকা আনা ইসলাম সংশোধন করে জানান। শাহাবুদ্দিনও। ওঁদের দুই কন্যা চিত্র ও চর্যাও।
শাহাবুদ্দিন মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার। তিনিই প্রথম, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রেডিও স্টেশনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পাকিস্তান সেনার গুলিবর্ষণের তোয়াক্কা না করে।
শাহাবুদ্দিনের ছবির গতি, রেখা অঙ্কন নিয়ে ভীষণ মুখর শিল্পী মকবুল ফিদা হুসেন, ওঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে, ডয়চে ভেলের অনুষ্ঠানে।
বাংলাদেশের শিল্পীদের বিষয়ে জানেন না। জানেন জয়নুল আবেদিনকে। বারবার ওলটপালট করছিলেন জয়নুল ও শাহাবুদ্দিনকে নিয়ে। ওঁর ধারণা, শাহাবুদ্দিন বয়সে বড়। সংশোধন করি। বলেন, ‘উস্কো গ্রেট মাস্টার’ (শাহাবুদ্দিন)। বলি, ‘শাহাবুদ্দিন নাবালক (ইয়ংচ্যাপ), জয়নুলের ছাত্র।’
হুসেনের সঙ্গে আরও একবার মোলাকাত, সাক্ষাৎকার (ডয়চে ভেলে) ওঁরই পরিচালিত ‘গজগামিনী’ ছবি নিয়ে বার্লিনে। সঙ্গে অভিনেত্রী মাধুরী দীক্ষিত। পরিচয় করিয়ে দিলেন মাধুরীর সঙ্গে। পরিচয়ের প্রথম বাক্য- ‘ইয়ে গ্রেট আর্টিস্ট শাহাবুদ্দিন কা দোস্ত। জাহাঙ্গীর গ্যালারিতে।’ মাধুরী বললেন (ইংরেজিতে। বাংলায় এই) :’বোম্বেতে আমিও হুসেনের সঙ্গে গ্রেট মাস্টার শাহাবুদ্দিনের ছবি দেখেছি।’
কলকাতায় শাহাবুদ্দিনের প্রদর্শনীতে মৃণাল সেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, গণেশ পাইন, প্রণবরঞ্জন রায়, যোগেশ চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। ক্যামেরায় ধৃত অন্তরঙ্গ ছবি দেখেছি। ঢাকায় প্রদর্শনী। অভিনেত্রী শাবানা আজমি নিউইয়র্ক থেকে হাজির। তিনিই উদ্বোধক। বলেন, ‘আমি অনার্ড’। একই কথা সদ্যপ্রয়াত রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের; কলকাতায় শাহাবুদ্দিনের ছবির প্রদর্শনী উদ্বোধনে, ‘আমি সুখী গ্রেট মাস্টারের ছবি উদ্বোধন করে।’
শাহাবুদ্দিনকে আমন্ত্রণ জানান রাষ্ট্রপতি ভবনে। শাহাবুদ্দিন এক সপ্তাহ কাটান কন্যা চিত্রকে নিয়ে।
শাহাবুদ্দিনের শিল্পে মানুষ। নানা মানুষ। বিশ্বের মানুষ। তিনি মুক্তিযোদ্ধা। কোমল-কঠিন সংগ্রাম সবই দেখেছেন। এখনও দেখছেন। এই দেখা ঘনিষ্ঠতা থেকেই তাঁর শিল্প, জীবন। শিল্পীর ব্যক্তিজীবন, বিভিন্ন আঙ্গিকে।
অবন ঠাকুরের কথা ধার করে বলি, শাহাবুদ্দিনকে খুঁজে পাওয়া যাবে ছবিতে, ব্যক্তিজীবনের শাহাবুদ্দিনের জীবনচরিতে। জন্ম ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫০, নরসিংদী জেলার রাজপুরে। আজ তাঁর সত্তর বছরের শুরু। জন্মদিনে আন্তরিক শুভেচ্ছা।
কবি
Leave a Reply