করোনা সংকট ও বন্যায় সার্বিক অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় দেশ এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। তার পরও সরকার জীবন-জীবিকার চাকা সচল রাখার জন্য নানামুখী পদক্ষেপ এবং বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে। তারই মধ্যে যুক্ত হয়েছে আরেক সংকট লঞ্চ ও ট্রলারডুবি এবং যা এখন সরকারের ওপর ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে অভিহিত হয়েছে। করোনায় যে ক্ষতি হয়েছে এবং হবে, তা কাটিয়ে উঠতে সরকার হিমশিম খাচ্ছে। সম্প্রতি গ্যাস দুর্ঘটনায় ও বারবার লঞ্চ এবং ট্রলারডুবিতে মানুষের মৃত্যু খুবই দুঃখজনক। যাদের পরিবারে ঘটনা ঘটেছে, তারাই বুঝতে পারে কী যে কষ্ট বহন করছে? এ ছাড়া নিহতদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবারের মূল কর্তা বা আয়ের মূল ব্যক্তি ছিলেন। একবার চিন্তা করুন, পরিবারগুলো কীভাবে তাদের সংসার চালাবে।
গত ৫ আগস্ট নেত্রকোনার মদন উপজেলার উচিতপুর হাওরে যাত্রীবাহী ইঞ্জিনচালিত নৌকা ডুবে ১৮ জন মাদ্রাসার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর প্রাণহানি হয়। নিহতরা ময়মনসিংহ সদর উপজেলার একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক। গণমাধ্যমে জানতে পারি, ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষকরা মদনের উচিতপুর এলাকায় হাওর ভ্রমণে আসেন। ভ্রমণে এসে চালকের অবহেলার কারণে মা-বাবা হারাল তাদের প্রিয় সন্তানকে এবং পরিবার হারাল তাদের প্রিয়জনকে। আর কোনোদিন ফিরে পাবে না তাদের আদরের মানুষকে।
মাত্র ৩৫ দিনের মাথায় সেই নেত্রকোনার হাওরপাড়ে আবারও মৃত্যুর মিছিলের খবর শুনতে পেলাম, যা খুবই মর্মান্তিক। এ জেলার সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা উপজেলার গুমাই নদীতে বেপরোয়া বালিবাহী একটি স্টিলের নৌকার সঙ্গে সংঘর্ষে ডুবে যায় যাত্রীবাহী একটি ট্রলার। মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় পাঁচ শিশু, চার নারীসহ ১০ জন নিহত হন। অধিক মুনাফার লোভে নির্ধারিত ট্রলারের জায়গায় ফিটনেসবিহীন ট্রলারে যাত্রী পরিবহন করায় এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে ওখানকার লোকজন মনে করছেন।
এ ছাড়া গত ২৯ জুন বুড়িগঙ্গায় লঞ্চডুবির দুর্ঘটনায় ৩৪ জনের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনাটি দেখলে মনে হয় চালকদের খামখেয়ালির কারণে ওই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। রাজধানীর সদরঘাটের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে ‘এমভি ময়ূর-২-এর ধাক্কায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ‘এমএল মর্নিং বার্ড’ ডুবে যায়। লঞ্চডুবির ওই ঘটনায় অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগে কয়েকজনের বিরুদ্ধে দ-বিধির ২৮০, ৩০৪ (ক), ৩৩৭ ও ৩৪ ধারায় একটি থানায় মামলা করা হয়। এই ধারাগুলোয় আসলেই কঠিন বিচার হওয়ার সুযোগ নেই। মামলাটি বিচারাধীন। পরে যদিও এতে লঞ্চের মালিকসহ চালক এবং দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত লঞ্চের অন্যান্য কর্মচারী গ্রেপ্তার হন। নৌপরিবহনমন্ত্রীর নির্দেশনা ও কার্যক্রম খুবই তৎপর ছিল এবং তার ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। এখন অপেক্ষা করতে হবে চূড়ান্তভাবে কী বিচার হয়। সংবাদপত্রে জানতে পারি, গত ২৯ বছরে দেশে নৌপথে দুর্ঘটনায় প্রায় ৩ হাজার ৭০০ জনের প্রাণহানি ঘটেছে এবং এমনকি অনেকের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি, যার সংখ্যা হবে প্রায় ৫০০।
এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হচ্ছে- কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ে ঘাটতি, অদক্ষ চালক বা মাস্টার নিয়োগ, আইনের দুর্বলতা, চালকদের বেপরোয়া, যাত্রীদের নিজস্ব সচেতনতা ও সতর্কতার অভাব, অধিক মুনাফার আশায় ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, ফিটনেসবিহীন নৌযান চলাচল, আসামিরা গ্রেপ্তার হলেও সহজেই জামিনে বের হওয়া এবং মালিকপক্ষ সঠিকভাবে নিয়মকানুন মেনে না চলা ইত্যাদি। এ ছাড়া এসব দুর্ঘটনায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া একটি কারণ। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে দেশে নৌপথে লঞ্চ বা ট্রলারসহ অন্যান্য নৌযান ডুবির মতো দুর্ঘটনা বেশি সংঘটিত হয়। দেশের অধিকাংশ নৌ-দুর্ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন ও তদন্ত প্রতিবেদন জমার মধ্যেই আটকে থাকে বলে কেউ কেউ মনে করেন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও নেওয়া হলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। যখন ঘটনা ঘটে তখন আমরা সবাই খুবই তৎপর থাকি, কিন্তু কালের পরিক্রমায় ঘটনা এবং বিচার কার্যক্রম হারিয়ে যায়। আবার অনেক স্বজন অর্থের বিনিময়ে মামলাগুলো মীমাংসা করে ফেলে, এটা বিচার না হওয়ার একটি কারণ।
২০১৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পদ্মা নদীতে একটি লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে। যেখানে ‘এমভি মোস্তফা’ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনায় ৭০ যাত্রীর প্রাণহানি হয়। ওই দুর্ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করে এবং কমিটি কয়েকজন অপরাধীকে শনাক্ত করার পাশাপাশি ২৪টি সুপারিশ করে। যার কোনোটি বাস্তবায়ন বা কার্যকর হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। গণমাধ্যমে জানতে পারি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নৌ-দুর্ঘটনায় সঠিক কারণ বের করতে প্রায় ৯০০ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে কয়েক হাজার মামলাও হয়েছে। তবে বড় ধরনের শাস্তির নজির আছে কিনা আমার জানা নেই। অথচ অপরাধীদের যথাযথ বিচার তো হয়-ই না, বরং দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চগুলোকে সামান্য মেরামত করে একই চালক, মাস্টার ও ক্রুদের দিয়ে আবার চালাতেও দেখা যায়।
আমাদের দেশে এ জাতীয় দুর্ঘটনায় অভ্যন্তরীণ নৌ অধ্যাদেশ, ১৯৭৬-এর আওতায় মামলা করা হয়। কোনো কোনো দুর্ঘটনায় মামলা করতে গেলে দ-বিধির ধারাও প্রয়োজন হয়। অধ্যাদেশের ৫৫ ধারা অনুযায়ী ঝড়ের সংকেত চলাকালীন নৌযাত্রা নিষিদ্ধ। কিন্তু অনেক নৌযান মালিক বা চালক তা অনুসরণ করেন না। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ধারার শর্ত না মানলে অভ্যন্তরীণ লঞ্চ বা ট্রলারের চালক কিংবা মাস্টারের তিন বছর পর্যন্ত কারাদ- বা ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ডের বিধি রয়েছে।
অধ্যাদেশের ৭০ ধারার ২ উপধারা অনুসারে কোনো অভ্যন্তরীণ নৌযান দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যু বা কোনো ব্যক্তি আহত বা অন্য কোনো নৌযানের আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুর্ঘটনাটি নৌযানের ত্রুটি বা অভ্যন্তরীণ নৌযানের মালিক, মাস্টার বা কোনো কর্মকর্তা বা ক্রুদের অযোগ্যতা বা অসদাচরণ বা কোনো আইন ভঙ্গ ইত্যাদি কারণে সংঘটিত হয়। তা হলে ওই দুর্ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের প্রত্যেকেই পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদ- কিংবা ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ডে দ-িত হতে পারেন।
আবার কিছু ধারা রয়েছে, যাতে মামলা হলে তেমন কোনো বিচার নাও হতে পারে এবং শাস্তি আছে তা হলো নামেমাত্র। এসব কারণে বারবার দুর্ঘটনা ঘটছে। কারণ তারা অপরাধ করে অল্পতে আবার মুক্তি পেয়ে যায়। এটাই হলো আইনের দুর্বলতা। তাই তারা এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটাতে ভয় পায় না। আমি মনে করি, অভ্যন্তরীণ নৌ অধ্যাদেশ-১৯৭৬ পরিবর্তন করে বা সংশোধন করে নতুন যুগোপযোগী আইন করা দরকার, যাতে কোনো অপরাধী মানুষের প্রাণহানি ঘটিয়ে পার পেয়ে যেতে না পারে। আর নতুন আইন না হওয়া পর্যন্ত বর্তমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ হওয়া উচিত।
এ ছাড়া দুর্ঘটনা রোধে যাত্রীদের অধিকতর সচেতন ও সতর্ক থাকা, নৌপুলিশের তদারকি ও মনিটরিং ব্যবস্থা বৃদ্ধি, সরকারি নিয়মনীতি অনুযায়ী দক্ষ চালক, মাস্টার ও অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া, দ্রুত তদন্ত করে অপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা এবং পাশাপাশি নৌযানে নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কার্যকরী মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা খুবই প্রয়োজন।
শফিকুল ইসলাম : শিক্ষক ও সাবেক সভাপতি-শিক্ষক সমিতি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ
Leave a Reply