রাহাতুর রহমান গত বছরের ৮ অক্টোবর ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে আবেদন করেন। ওই বছরের ৩০ ডিসেম্বর পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। গত ৮ আগস্ট তাকে লাইসেন্স দেওয়ার তারিখ ছিল। ২৭ আগস্ট লাইসেন্সের জন্য তিনি সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) মিরপুর সার্কেলে এসে জানতে পারেন, আরও এক বছর পর তার লাইসেন্স প্রিন্ট হবে। ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট লাইসেন্স পাবেন তিনি। ক্ষুব্ধ রাহাতুর জানালেন, গত ১০ মাসে পাঁচবার বিআরটিএতে এসেছেন। আর কত ঘুরবেন! তার প্রশ্ন- লাইসেন্স পেতে কেন দুই বছর লাগবে। এর চেয়ে কম সময়ে তো এইচএসসি পাস করা যায়।
পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে গত বছরের ১৪ নভেম্বর পরীক্ষা দেন আরিফুর রহমান। তারও ২৭ আগস্ট লাইসেন্স পাওয়ার নির্ধারিত দিন ছিল। তাকেও নতুন তারিখ দেওয়া হয়েছে আগামী বছরের ২৫ আগস্ট। শুধু রাহাতুর বা আরিফুর নন, যত আবেদনকারী লাইসেন্সের প্রিন্ট নিতে বিআরটিএতে আসছেন, তাদের সবাইকে আগামী বছরের তারিখ দিয়ে বিদায় করা হয়েছে। আগামী এক বছরে কাউকে লাইসেন্স দেবে না বিআরটিএ। লাইসেন্স বিতরণ কাউন্টারের কর্মী জানালেন, বছরখানেক ধরে প্রিন্ট বন্ধ। গত ছয় মাসে একটি লাইসেন্সও দেওয়া হয়নি। যারা আসছেন, তাদের নতুন তারিখ দেওয়া হচ্ছে। শুধু ‘ভিআইপি সুপারিশ’ নিয়ে আসা হাতেগোনা কয়েকজনকে প্রিন্ট দেওয়া হয়েছে। মিরপুর সার্কেলে লাইসেন্সের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বিআরটিএর সহকারী পরিচালক শামসুল কবির জানালেন, লাইসেন্সের প্রিন্ট কপি সরবরাহের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ শেষ। নতুন ঠিকাদার নিয়োগ প্রক্রিয়া চলছে। এ কারণে লাইসেন্স প্রিন্ট দেওয়া যাচ্ছে না। এর বেশি জানতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।
মিরপুর সার্কেল সূত্রে জানা গেল, শুধু বিআরটিএর মিরপুর শাখাতেই ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ৮০ হাজার ৮৫৩টি ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রিন্টের অপেক্ষায় রয়েছে। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ছবি ও আঙুলের ছাপ দেওয়ার অপেক্ষায় আছেন আরও ১৮ হাজার আবেদনকারী। নতুন আবেদনকারী রয়েছেন ছয় হাজার। সব মিলিয়ে শুধু মিরপুর সার্কেলে এক লাখ পাঁচ হাজার আবেদনকারীর লাইসেন্স আটকে আছে। সারাদেশে বিআরটিএর ৭৭ সার্কেলে ৩০ আগস্ট পর্যন্ত প্রিন্টের অপেক্ষায় রয়েছে ৯ লাখ ১৩ হাজার ২৫৮টি। ছবি, আঙুলের ছাপ দেওয়া, নতুন আবেদনসহ ১২ লাখের বেশি আবেদনকারী লাইসেন্সের জন্য ঘুরছেন।
করোনা মহামারিতে দুই মাস বন্ধ ছিল বিআরটিএর কার্যক্রম। চালকের পরীক্ষা, বায়োমেট্রিক কার্যক্রম পাঁচ মাস বন্ধ থাকার পর ২৩ আগস্ট থেকে নতুন আবেদন নেওয়া শুরু হয়েছে। তবে করোনার আগে থেকেই লাইসেন্স সংকট চলছে। কারণ, কোন প্রতিষ্ঠান শতকোটি টাকার লাইসেন্স সরবরাহের কাজ পাবে, তা নিয়েই মূলত এই টানাপোড়েন। চলছে দরপত্র বাতিল ও পুনরায় কার্যাদেশ প্রদান এবং রিভিউ আপিল।
ডুয়েল ইন্টারফেস পলিকার্বনেট স্মার্টকার্ডে ছাপা ড্রাইভিং লাইসেন্স সরবরাহের কাজ দিয়ে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান মাদ্রাজ সিকিউরিটি প্রিন্টার্স প্রাইভেট লিমিটেডের সঙ্গে গত ২৯ জুলাই চুক্তি সই করেছে বিআরটিএ। এর আগে ১৩ জুলাই প্রতিষ্ঠান ‘নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড’ পায়। তবে এর বিরুদ্ধে ‘রিভিউ’ করেছে মাদ্রাজ সিকিউরিটির সঙ্গে দরপত্রে অংশ নেওয়া সেলপ স্মার্টকার্ডস অ্যান্ড সলিউশনস। প্রতিষ্ঠানটির অভিযোগ, মাদ্রাজ সিকিউরিটি বিভিন্ন দেশে কালো তালিকাভুক্ত। তারা কারসাজি করে কাজ পেয়েছে। এরই মধ্যে মূল্যায়ন কমিটি রিভিউ মিটিং করেছে। নালিশ নিষ্পত্তি না হলে তা মামলা পর্যন্ত গড়াতে পারে।
এদিকে, চুক্তি সই হলেও মাদ্রাজ সিকিউরিটির কাজ শুরু করতে আরও কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। তাই যাদের এক বছর পরের তারিখ দেওয়া হচ্ছে, তারা ওই সময়ে লাইসেন্স পাবেন- এ নিশ্চয়তা নেই। লাইসেন্স নিয়ে এ টানাপোড়েন বছরখানেক ধরে চলছে।
বর্তমানে লাইসেন্স সরবরাহের দায়িত্বে থাকা টাইগার আইটি ২০১৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য ১৫ লাখ কার্ড সরবরাহের দায়িত্ব পায়। কিন্তু চাহিদার কারণে নির্ধারিত সময়ের আগেই ১৫ লাখ লাইসেন্স প্রিন্ট দিতে হয়। বিশ্বব্যাংকের কালো তালিকাভুক্ত এ প্রতিষ্ঠানকে অন্তর্বর্তী দায়িত্ব দিয়ে বাড়তি কার্ড নিতে পারেনি বিআরটিএ। ফলে গোলমেলে অবস্থা তৈরি হয় ড্রাইভিং লাইসেন্সে।
চাকরিপ্রার্থী বা বিদেশগামীরা এতে সবচেয়ে বিপাকে আছেন। দেশে পরীক্ষা পাসের সনদ দেখিয়ে গাড়ি চালানো গেলেও চাকরিতে ও বিদেশ কাজে যেতে এ সুযোগ নেই। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে সাধারণ ছাপা লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। তবে তা খুব বেশি কাজে লাগে না।
পরীক্ষায় পাস করে ফি জমা দিয়েও লাইসেন্স না পেয়ে বিপাকে আছেন চালকরা। লাইসেন্স সঙ্গে না থাকায় পথে আটকাচ্ছে পুলিশ। মামলায় পরে জরিমানা গুনতে হচ্ছে তাদের। গত রোববার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধ মোড়ে আকরাম হোসেন নামের এক মোটরসাইকেল চালককে আটকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চান ট্রাফিক সার্জেন্ট। তিনি পুলিশকে জানান, ড্রাইভিং পরীক্ষায় পাস করেছেন, ফিঙ্গার প্রিন্ট ও টাকা জমা দিয়েছেন। এর কপি আছে। কিন্তু সার্জেন্টের দাবি, মোটরসাইকেল চালাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স থাকতে হবে। নয়তো জরিমানা করা হবে। পরে অবশ্য জরিমানা ছাড়াই পার পান আকরাম হোসেন। তিনি সমকালকে বলেছেন, এক বছর ধরে লাইসেন্সের জন্য ঘুরছেন।
Leave a Reply