একটি নৃসংস হত্যাকান্ডের খবর পড়ে কাল সারারাত ঘুমুতে পারিনি। দেশ যেন দ্বিপদী ছাগলে ভরে গেছে। ছাগলকে যতোই নির্বোধ প্রাণী বিবেচনা করা হোক না কেন তার চেয়েও যেন বড় নির্বোধে ভরে আছে এই সমাজ। রাজশাহীর ঘটনা সামনে না এলে তা মনেই হতো না।
রাজশাহীতে ট্রাক চাপায় ছাগল পিষ্ট হওয়ার ঘটনায় ১৬ কিলোমিটার পথ পিছু নিয়ে ট্রাক ড্রাইভার আবু তালেবকে (৪০) পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। পুলিশ এই ঘটনায় ঘটনায় পাঁচজনকে আটক করেছে। ট্রাক ড্রাইভার তালেব পুঠিয়ার ঝলমলিয়া এলাকার বাসিন্দা। গত শুক্রবার রাতে তালেবকে পেটানোর পর গতকাল শনিবার ভোরে তিনি পুঠিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, শুক্রবার রাত ৮টার দিকে রাজশাহীর বাগমারার ভবানীগঞ্জ এলাকায় ট্রাক থেকে মাল নামিয়ে ফিরছিলেন চালক আবু তালেব (৪০)। হঠাৎ দুটি ছাগল রাস্তার মাঝে এসে ট্রাকের নিচে পড়ে। চাকায় পিষ্ট হয়ে ছাগল দুটি মারা যায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে বাগমারার ভবানীগঞ্জ শিবজাইট এলাকার বাসিন্দা ও ছাগল মালিক গোলাম মোস্তফা তাঁর লোকজন নিয়ে ১০ থেকে ১৫টি মোটরসাইকেলযোগে ট্রাকের পিছু নেন। তাঁরা ১৬ কিলোমিটার ধাওয়া করে পুঠিয়ার বাসুপাড়ায় এসে ট্রাকড্রাইভার তালেবকে ঘেরাও করেন। এ সময় তালেব ট্রাক থেকে নেমে পালানোরও চেষ্টা করেন। কিন্তু মোস্তফা ও তাঁর সঙ্গীরা তালেবকে ধরে লাঠিসোঁটা দিয়ে বেদম পেটাতে থাকেন। নির্যাতনের পর তালেবকে মৃত ভেবে ফেলে রেখে যান হামলাকারীরা।
একপর্যায়ে স্থানীয় লোকজন তালেবকে উদ্ধার করে পুঠিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যান। গতকাল ভোরে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ট্রাকড্রাইভার মারা যান। পুঠিয়া থানার ওসি রেজাউল ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে হত্যা মামলা করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে।
আমাদের দেশে সড়ক, মহাসড়কে ছাগল অবাধে চড়ে বেড়ায়। সেটি চলন্ত গাড়ির নিচে কখন এসে জীবন উৎসর্গ করবে তা বোঝারও উপায় থাকে না। সেই ছাগলের জন্য এমন নৃসংসভাবে একজন ভারী গাড়ির ড্রাইভারকে মিটিয়ে মেরে ফেলার ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে পড়েছি। কতোটা পাশবিক হলে দুটি ছাগলের জন্য বিশাল বাহিনী নিয়ে ১৬ কিলোমিটার ধাওয়া করে এক ট্রাক চালককে খুন করা যায়? এই হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। নইলে এমন ঘটনা বার বার ঘটতে থাকবে।
বাংলাদেশে এমনিতেই ড্রাইভারের সংকট রয়েছে। বিশেষ করে ভারী যানবাহনের ড্রাইভারের চরম সংকট। মোট ভারী যানবাহনের অর্ধেকেরও বৈধ লাইসেন্স নেই। অন্যদিকে নিত্যদিনের দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান অনেক ড্রাইভার। ড্রাইভিং একটি ঝুঁকিপূর্ণ পেশা। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষকে তাদের গন্তব্যে পৌছে দেন। সচল রাখেন জীবিকার স্পন্দন। পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে আমাদের খাদ্য পরিবহন ব্যবস্থাপনা অক্ষুন্ন রাখছেন তারা। অথচ তাদের অধিকাংশের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য নেই। অনিশ্চয়তার ঘোরপাকে কাটছে ড্রাইভারদের জীবন। একজন ড্রাইভার যখন স্টিয়ারিং হাতে মহাসড়কে নামেন তখন মৃত্যু ঝুঁকিতে তার মাথাটা থাকে সবার আগে। তিনিই প্রথম বলী হন দুর্ঘটনার। গত ১৬ সেপ্টেম্বর যাত্রী কল্যান সমিতি আগস্ট মাসের দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়েছে, আগস্ট মাসে দেশের সড়ক-মহাসড়কে ৩৮৮টি দুর্ঘটনায় ৪৫৯জন নিহত ও ৬১৮জন আহত হয়েছে। দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ড্রাইভারদের সংখ্যাই সর্বাধিক। আগস্টে নিহত হয়েছেন ১৬৭জন ড্রাইভার। প্রতি মাসেই এভাবে ড্রাইভাররা জীবন দেওয়ার তালিকায় শীর্ষে থাকছেন।
সরকার দেশে দক্ষ চালক তৈরির চেষ্টায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে। তবুও দেশে বাস-ট্রাক চালানোর মতো ভারী যানবাহনের চালক সংকট রয়েছে প্রায় দুই লাখ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ এক বৈঠকে জানান, দেশে বাস-ট্রাক ও ট্যাংক লরি রয়েছে প্রায় পৌনে চার লাখ। এর মধ্যে দুই লাখ চালকের সংকট রয়েছে; যাঁদের ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ফলে চালক সংকটে তাঁরা বিপদে আছেন।
অন্যদিকে বিআরটিএ’র তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত সারাদেশে রেজিস্ট্রেশন নেয়া যানবাহনের সংখ্যা ছিল ৪৪লাখ ৭১হাজার ৬২৫টি। অন্যদিকে ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছে ৩৪ লাখ ১২ হাজার ৬৩৮টি। গত কয়েক মাস ধরে ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু হচ্ছে না ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি জটিলতার কারণে। লক্ষাধিক আবেদনকারী মাসের পর মাস ঘুরছেন, ড্রাইভিং লাইসেন্স হাতে পাচ্ছেন না। তবে সব মিলিয়ে যানবাহনের তুলনায় এখনো প্রায় ১০ লাখ চালকের হাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। অন্যভাবে বলা যায়, এখনো দেশে ১০ লাখ চালকের সংকট রয়েছে।
এমন পরিস্থিতিতে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে দুটি ছাগল মারা যাওয়ার ঘটনায় একজন চালককে দীর্ঘ পথ তাড়া করে পিটিয়ে মেরে ফেলার মতো ঘটনা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আমরা এ ব্যাপারে ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি, চালক ইউনিয়নসহ সংশ্লিষ্ট সকলের জোরালো অবস্থান প্রত্যাশা করি। আশা করি, প্রশাসন দায়ী ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করবে। মানুষরূপী এমন ছাগলদের কঠোর শান্তি না হলে দ্বিপদী ছাগলে দেশ ভরে যাবে। ফেসবুক থেকে।
Leave a Reply