ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস আজ
আমাদের প্রাণের শহর ঢাকা বসবাসের অযোগ্য; ২০১৮ সালে এমনই এক ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাজ্যের ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। বসবাসের অযোগ্য হওয়ার অনেক কারণের মধ্যে দূষণ ও যানজট অন্যতম। দূষণ ও যানজট আন্তঃসম্পর্কিত। সড়কে দীর্ঘ যানজট বায়ুদূষণ বৃদ্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। ঢাকার মতো এত যানজট অন্য কোনো মেগাসিটিতে নেই। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘নামবিও’ প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক ইনডেক্স-২০১৯’-এর তথ্য অনুযায়ী যানজটের দিক দিয়ে বিশ্বে প্রথম স্থানে রয়েছে ঢাকা। যানজটের মূল কারণ হিসেবে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বৃদ্ধিকে দায়ী করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী এই দূষণ আর যানজটের সমাধানের লক্ষ্যে প্রতিবছর ২২ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস’ উদযাপিত হয়। শহরকে যানজটমুক্ত করা, গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত করার আহ্বান জানানো, সপ্তাহে বা মাসে এক দিন রাস্তাগুলোকে গাড়িমুক্ত করে সংস্কার কাজ ও খালি জায়গা তৈরি করে খেলাধুলা বা বিনোদনের ব্যবস্থা করা, যান্ত্রিকতা থেকে মানুষকে একটু স্বস্তি দেওয়া ইত্যাদি বিষয় সামনে নিয়ে আসা এই দিবসের উদ্দেশ্য। এ ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠনের প্রয়াসে ব্যক্তিগত গাড়িমুক্ত দিবস নামে প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সামনে একটি ইভেন্ট আয়োজন করা হয়।
নামবিওর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্বের সবচেয়ে কম যানজটপূর্ণ শহরের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। এর পরের অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে সুইডেন (গোথেনবার্গ), সুইজারল্যান্ড (ব্রাসেলস), রোমানিয়ার দুটি শহর ব্রাসোভ ও তিমিসোয়ারা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যেখানে গণপরিবহন হতে পারত নাগরিকদের চলাচলের জন্য আদর্শ বাহন, সেখানে প্রতিনিয়ত বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা। এর মূল কারণ গণপরিবহনের নানা সীমাবদ্ধতা। গণপরিবহনের অপ্রতুলতার সঙ্গে টিকিট ব্যবস্থা না থাকা, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, নারীদের অনিরাপত্তা, পরিবহনে আরামদায়কতার অভাব ইত্যাদি। আবার অনেকেই সামাজিক আধিপত্য দেখানোর জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে থাকে।
২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল (ডিআই) প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা শহরের ৬ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করে রাস্তার ৭৬ ভাগ দখল করে আছে। ৬ থেকে ৮ ভাগ রাস্তা গণপরিবহনের দখলে আর রাস্তার বাকি অংশ পার্কিং ও অবৈধ দখলে রয়েছে। ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নানা সমস্যা। ব্যক্তিগত গাড়ির সঙ্গে গণপরিবহনের তুলনা করলে দেখা যায় ব্যক্তিগত গাড়ি বেশি রাস্তা দখল করে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগ সরেজমিন একটি জরিপ করে, এতে দেখা যায় একটি ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় যে পরিমাণ জায়গা দখল করে সমপরিমাণ জায়গা একটি হিউম্যান হলার দখল করে। ব্যক্তিগত গাড়িতে সর্বোচ্চ ৫ জন আরোহণ করতে পারে; পক্ষান্তরে হিউম্যান হলারে ১৫ জন আরোহণ করতে পারে। অপরদিকে ৩টি ব্যক্তিগত গাড়ি ১৫ জন নিয়ে যে স্থান দখল করে সে স্থান দখল করে ৩৬ থেকে ৪০ জন যাত্রী ধারণ ক্ষমতার একটি গণপরিবহন।
ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে জৈব জ্বালানির চাহিদা, বাড়ছে বায়ুদূষণ। বুয়েটের দুর্ঘটনা রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং রোড সেফটি ফাউন্ডেশন আয়োজিত ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট : আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ নামক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনা অনুযায়ী দীর্ঘ যানজটে বসে থেকে প্রতিদিন মানুষের ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, বছরে এর আর্থিক মূল্য ৩৭ হাজার কোটি টাকা। ঘণ্টায় মাত্র পাঁচ কিলোমিটার নেমে এসেছে যানবাহনের গতি। অন্যদিকে বর্তমানে যে হারে নতুন যানবাহন যুক্ত হচ্ছে সেই হারে সড়কের আকার বা সংখ্যা বাড়ছে না। চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে যেসব পরিকল্পনা বা সুপারিশ গৃহীত হচ্ছে তার বেশিরভাগই স্বল্পমেয়াদি। যাত্রীবান্ধব গণপরিবহন ব্যবস্থা কার্যকরভাবে গড়ে তুলতে ব্যর্থ হওয়ায় যাত্রীসেবার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বেড়েছে দুর্ঘটনা।
করোনাকালীন মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণ থাকলেও মে মাস থেকে রাজধানীর অফিস-আদালত খুলতে শুরু করায় যান চলাচল শুরু হয়। জুন মাস থেকে রাস্তায় গাড়ির উপস্থিতি দেখে করোনার অস্তিত্ব আর বোঝা যাচ্ছিল না। আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে অন্য সময়ের মতো আবার অসহ্য যানজট লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ওয়ার্ল্ড ট্রাফিক কনজেশন ইনডেক্সে ঢাকা আবার উঠে এসেছে এক নম্বরে। কিন্তু করোনা আমাদের একটি শিক্ষা দিয়েছে যে, কীভাবে ট্রাফিক অব্যবস্থাপনার কারণে রাজধানী চলাচল ও বসবাসের অযোগ্য হয়ে ওঠে। আর নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি ও যানজট না থাকলে ঢাকার এক স্থান থেকে আরেক স্থান যেন অনেক নিকটে চলে আসে। থাকে না বায়ু ও শব্দদূষণ। করোনার এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যৎ যোগাযোগ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অল্প জায়গায় বেশি যাত্রী পরিবহন করা যায় এমন বাহনকে প্রাধান্য দিয়ে পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর জোর দেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে বাসের সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন। ফিটনেসবিহীন গাড়ি পরিহার করে ভালো মানের গাড়ি নামানো উচিত যেন সব পর্যায়ের মানুষ গণপরিবহনে যাতায়াতে উৎসাহিত হয়। উন্নত বাস সার্ভিস চালুর মাধ্যমে প্রাইভেট কারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা সম্ভব। একদিন বেজোড় সংখ্যা এবং অন্যদিন জোড় সংখ্যার নাম্বার প্লেট অনুযায়ী প্রাইভেট গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা করা যায়। সেক্ষেত্রে যানজট নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ হয়ে যাবে। যানজট হ্রাসে অতিসত্বর প্রাইভেট কার ব্যবহারে নিরুৎসাহী করতে বাসের যাত্রীসেবার মান বৃদ্ধিতে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
ডিন; বিজ্ঞান অনুষদ, স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ। kamrul_sub@hotmail.com
Leave a Reply