ওভারটেকের ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় দুই বাসের মধ্যে চাপা খেয়ে অনেকে মারা যাচ্ছেন, অনেকে পঙ্গু হচ্ছেন। ফ্লাইওভারে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা রাখা আছে। অথচ আলো নেই। ফ্লাইওভার নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে না। ফ্লাইওভারগুলো সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাভুক্ত না হওয়ার ফলে দুর্ঘটনার সঠিক কারণ জানা যাচ্ছে না। মানুষের লাশ পাওয়া যাচ্ছে ফ্লাইওভারের ওপর। তাই রাতে সন্ত্রাসীদের নিয়মিত, নিরাপদ স্থানে পরিণত হচ্ছে অনেক ফ্লাইওভার। ঢাকার কয়েকটি ফ্লাইওভারে দেখেছি পরিবেশবান্ধব কর্মসূচির সাইনবোর্ড। কিছু ফুলগাছ লাগানোর টব রাখার ব্যবস্থা আছে ফ্লাইওভারের দুইপাশে। কিন্তু সেখানে কোনো ফুলগাছ নেই, হয়তো কোনো এক সময় ছিল। সড়ক বিভক্তকরণ বা ডিভাইডার নেই উল্লেখযোগ্য স্থানগুলোয়। বাংলাদেশের সড়কগুলো সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় নেই। তাই অনেক দুর্ঘটনার আসল কারণ জানা যাচ্ছে না। এই রকম আরও কারণ আছে সড়ক দুর্ঘটনার। তবে প্রধান কারণগুলো চিহ্নিত করে আগামীর সড়কব্যবস্থা নিরাপদ করার উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। প্রথমে চালকের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে শতভাগ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে দিতে হবে। যত দুর্ঘটনা হয়, এর ৯০ শতাংশই চালকের কারণে হয়। অথচ বিশ্বব্যাপী গাড়িচালনা একটি নন্দিতশিল্প এবং এর প্রতিযোগিতা হয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এই প্রতিযোগিতার ফলে গাড়িচালক তার দক্ষতা প্রকাশ করতে পারেন। যিনি যত সুন্দর নিরাপদভাবে গাড়ি চালাতে পারেন, তিনিই পুরস্কৃত হন এবং নিজেকে মর্যাদাবান ও দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে মনে করেন। এই রকম প্রতিযোগিতার কারণে বিদেশে গাড়ি দুর্ঘটনার সংখ্যা অনেক কম।
আমাদের দেশেও সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বার্ষিক জাতীয়ভিত্তিক গাড়িচালনার প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপজেলা, জেলা, বিভাগ হয়ে জাতীয় পর্যায়ে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতে পারে। এতে যে চালক যত সুন্দরভাবে ও নিরাপদে গাড়ি চালাবেন, তিনিই পুরস্কৃত হবেন। যেসব সড়ক বেশি বাঁকা ও অপ্রশস্ত, ওই সড়কগুলোকে সোজা করার উদ্যোগ নিতে হবে।
রাজধানীসহ জেলা শহরগুলোকে অবিলম্বে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনতে হবে। সিগন্যালব্যবস্থা দেশব্যাপী আরও সম্প্রসারিত ও ডিজিটালাইজ করতে হবে। গাড়ির ফিটনেসের দিকে শতভাগ দৃষ্টি দিতে হবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে। বিদেশে গণপরিবহন দেখলে উঠতে ইচ্ছা করে আর আমাদের দেশের গণপরিবহনের অবস্থা কী, তা সবাই জানি। শহরের গাড়ির গতি ও আন্তঃজেলার গাড়ির গতি নির্ধারণ করে দিতে এবং নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সড়ক ডিভাইডারের পরিধি বাড়াতে হবে।
আমাদের দেশের ৯৯ শতাংশ গাড়ির হেডলাইটের বিম অ্যাডজাস্ট করা হয়নি। এক চালককে দিয়ে একনাগাড়ে ৮ ঘণ্টার বেশি গাড়ি চালানো যাবে না, বিশেষ করে গণপরিবহনের ক্ষেত্রে। গাড়ি রাস্তায় নামানোর আগে যেসব বিষয় পরীক্ষা করার নিয়ম আছে, তা নিয়মিত দেখভাল করার জন্য মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোকে দেশব্যাপী আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রতিটি টারমিনালে এ বিষয়ের সর্তকতামূলক সাইনবোর্ড থাকতে হবে। ইতোমধ্যে কিছু সড়ক সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা হয়েছে। ওইসব স্থানে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশে লোপ পেয়েছে। শহীদ রমিজ উদ্দীন বিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর শিশু-কিশোর ও যুবকদের দ্বারা পরিচালিত সড়ক সংস্কার আন্দোলন বেগবানভাবে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ল। এই আন্দোলন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল সড়কে কী পরিমাণ অনিয়ম চলছে! ওই কিশোর-কিশোরীরা মাঠে নেমে এমনসব তথ্য ও সত্য উদ্ঘাটন করল, তা দেখে জনগণ স্তম্ভিত হয়ে গেল। দেখা গেল রাস্তার ১০০টি গড়ির মধ্যে ৯০টিরই কাগজপত্র ঠিক নেই। ভিভিআইপি, ভিআইপি, সিআইপিসহ সর্বোচ্চ পর্যায়ে সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে প্রায় সব পর্যায়েই ব্যাপক অনিয়ম পত্রিকায় প্রকাশিত হলো। অনিয়মের জন্য অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তিও এই ছাত্রদের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলো। এই শিশু-কিশোররা যদি ওই সময় অনিয়মের জন্য জরিমানা চালু করত, তা হলে সরকারি-বেসরকারি ক্ষমতাধররাও জরিমানা দিতে বাধ্য হতেন। সপ্তাহের অধিক সময় ধরে তারা আন্দোলন চালিয়ে সরকারের কাছে কয়েক দফা দাবি উত্থাপন করেছিল। ওই সময় সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা খুব কম ছিল। এই আন্দোলন বিশ্বব্যাপী প্রচারিত ও প্রসংসিত হয়েছিল। উত্থাপিত দাবিগুলো এখন পর্যন্ত যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। তাই কিছুদিন যেতে না যেতেই আগের অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে সড়কচিত্র। সব স্কুলে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যায়ক্রমে স্কুলবাসের ব্যবস্থা করা হবে, স্কুলের সামনে স্পিডব্রেকার দেওয়া হবে, স্কুলের সামনে সিগন্যালব্যবস্থা আরও যুগোপযোগী করা হবে বলে ঘোষণা করেছিল সরকার। কই, কতটুকু বাস্তবায়ন করা হয়েছে বাস্তবে? বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ধরনের সড়ক তৈরি হচ্ছে, চালকদের দেওয়া হচ্ছে প্রশিক্ষণ, চলছে নানাবিধ গবেষণা। এ ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থা কী? নিরাপদ সড়কের দাবি আজ জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে।
ভাস্কর রাসা : জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত ভাস্কর্যশিল্পী
Leave a Reply