আজকের ঢাকায় কত শত আধুনিক ভবন। সুরম্য অট্টালিকা। দেখে ভাল লাগে বৈকি। পাশাপাশি একই শহরে আছে বহুকাল আগের পুরনো স্থাপনা। হ্যাঁ, পুরনো। তবে আলাদা গুরুত্বের। ভবনগুলোর দিকে তাকিয়ে বিভন্ন সময় ও কালের ঢাকাকে চেনা যায়। জানা যায় বিগত দিনের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে। গোটা দুনিয়া এ ধরনের স্থাপনা সংরক্ষণে বিশেষ মনোযোগী। তবে বাংলাদেশে উল্টো। সচেতন প্রয়াস খুব একটা দেখা যায় না। আমাদের চোখের সামনেই অসংখ্য স্মারক নষ্ট হয়ে গেছে।
আর ঠিক এখন এই মুহূর্তে ধ্বংস করা হচ্ছে ঢাকার প্রথম যাত্রীবাহী রেলওয়ের শেষ স্মৃতিচিহ্ন। প্রায় ১৩৫ বছরের পুরনো স্মৃতি ধরে রেখেছে যে ভবন, সেটি ভাঙ্গার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। রেলওয়ে হাসপাতাল হিসেবে নির্মিত ভবনটি এখন সরকারী কর্মচারী হাসপাতাল নামে পরিচিত। একই স্থানে নতুন ভবন নির্মিত হবে। তাই ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত!
অথচ ভবনটি সেই ব্রিটিশ আমলের। ইতিহাসবিদরা বলছেন, ১৮৮৫ সালের দিকে ঢাকায় প্রথমবারেরর মতো যাত্রীবাহী রেলওয়ে চালু করা হয়। স্টেশন স্থাপন করা হয় ফুলবাড়িয়ায়। আর্কাইভ ঘাঁটলে সে স্টেশনের ছবি এখনও দেখা যায়। কিন্তু শুধু স্টেশন নয়, আশপাশের বিশাল এলাকা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল রেলওয়ে কমপ্লেক্স।
ইতিাসবিদ মুনতাসীর মামুনের মতে, মোট জায়গার পরিমাণ ছিল প্রায় ৫০ একর। স্টেশন ছাড়াও এখানে রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, কর্মচারীদের কোয়ার্টারসহ নানা কিছুর ব্যবস্থা রাখা হয়।
এলাকাটি সম্পর্কে আরও বিস্তারিতভাবে জানা যায় ঢাকা বিষয়ক গবেষক হাশেম সূফীর কাছ থেকে। ঢাকা ইতিহাস গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান নির্বাহীর দেয়া তথ্য মতে, বর্তমান ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড, টেলিফোন ভবন, নগর ভবন, পুলিশ সদর দফতর, গোটা ওসমানী উদ্যান, হাইকোর্টের একাংশ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক হল ওই কমপ্লেক্সের জায়গায় নির্মিত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখান থেকে ট্রেন লাইন সরিয়ে নেয়া হয়। কমলাপুরে স্থানান্তরিত হয় স্টেশন। একইসঙ্গে ভবনগুলো পরিত্যক্ত বা অন্য কাজে ব্যবহার হতে থাকে। বর্তমান পর্যন্ত এসে টিকে আছে শুধু রেলওয়ে হাসপাতাল ভবনটি।
হাশেম সূফীর মতে, খুব সম্ভবত ১৮৯০ সালের দিকে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন করে হাসপাতাল চালু করা হয়। লাল রঙের দ্বিতল ভবন ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলীর অনন্য নিদর্শন। ব্রিটিশরা রেলওয়ের সব স্থাপনায় লাল রং ব্যবহার করত। হাসপাতালটির ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি। ভবন নির্মাণে লাল রঙের ১০ ইঞ্চি মাপের ইট ব্যবহার করা হয়। বিশেষ ইট তখন ভারতের বর্ধমান থেকে আনা হয়েছিল বলে জানান এ ইতিবাসবিদ। সব মিলিয়ে বেশ দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছিল ভবনটি। তার চেয়ে বড় কথা, এখনও পর্যন্ত প্রাচীন রেলওয়ের স্মৃতি ধরে রেখেছে। এ এলাকায় রেল ছিল। স্টেশন ছিল। ভবনটি সে ইতিহাসের কথা মনে করিয়ে দেয়। এসব বিবেচনায় ঢাকার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে ভবনটি সংরক্ষণ করা হচ্ছিল। কিন্তু সম্প্রতি রেলওয়ে হাসপাতাল ভবন বাদ দিয়ে ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার নতুন তালিকা প্রকাশ করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।
এ ধারাবাহিকতায় গত ১ সেপ্টেম্বর ভবনটি ভেঙ্গে নতুন ভবন নির্মাণের কথা জানা যায়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুনের দেয়া তথ্য মতে, এখানে হবে নতুন ১৬ তলা হাসপাতাল ভবন। ৩৮০ কোটি টাকার প্রকল্প একনেকে অনুমোদন লাভ করেছে বলেও জানান তিনি।
বুধবার ফুলবাড়িয়ায় গিয়ে দেখা গেল, শুধু কথা নয়। কাজও শুরু হয়ে গেছে। ভবনটি ইতোমধ্যে টিন দিয়ে ঘিরে নেয়া হয়েছে। ভেতরে চলছে ভাঙ্গার প্রস্তুতি। বেশ ক’জন শ্রমিক প্রাথমিক কাজ শুরু করেছেন। হাসপাতাল বড় করার প্রয়োজনেই এই ভাঙ্গা গড়ার সিদ্ধান্ত। এর বিরোধিতা করার সুযাগ নেই।
তবে ঐতিহ্যবাহী ভবন যেমন আছে তেমন রেখেও সেখানে নতুন ভবন নির্মাণ করা যেত কিনা, সে প্রশ্ন উঠছে। এটিকে সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে ইতিহাসবিদরা বলছেন, রেলওয়ের কোন পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর নেই। ভবনটিতে একটি সুন্দর জাদুঘর হতে পারে। জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করে সময়টাকে ধরে রাখা রাখার তাগিদ দিচ্ছেন তারা।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালক হান্নান মিয়ার সঙ্গে। এ ধরনের স্থাপনা সংরক্ষণের কাজ অধিদফতরই করে থাকে। রেলওয়ে হাসপাতালের বেলায় কী হচ্ছে? জানতে চাইলে হতাশই হতে হয়। রাজধানী শহরের এমন একটি ভবনের ইতিহাস তো দূর থাক, অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানা নেই এই আমলার। অনায়াসে তা স্বীকার করে নিয়ে তিনি বললেন, ‘ভবনটি সম্পর্কে আমার ঠিক জানা নেই। আমার নলেজের বাইরে!’
Leave a Reply