বিশ্বজুড়ে দিবসটি এমন সময় পালিত হচ্ছে, যখন গোটা বিশ্ব করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। স্বাভাবিকভাবেই এ বছর বিশ্ব নদী দিবসে বাংলাদেশ প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘ভাইরাসমুক্ত বিশ্বের জন্য চাই দূষণমুক্ত নদী’।
বাংলাদেশে দিবসটি দশম বছরের মতো পালিত হওয়ার সময় আমরা দেখছি- আমাদের দেশে নদীর সংখ্যা ক্রমাগত কমছে। কেন কমছে, দিবস পালনের মাধ্যমে নদী রক্ষার দাবি তোলার সঙ্গে সঙ্গে সেই অনুসন্ধানও জরুরি। মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা শুনি- নদীটি আগে অনেক বড় ছিল, এখন ছোট হয়ে আসছে। অনেক নদী সম্পর্কে শোনা যায় আগে এ নদীতে বছরভর পানি থাকত, এখন আর থাকে না। অনেক সময় শোনা যায়, ঘন ঘন জলাবদ্ধতা হচ্ছে। আমরা জানি, নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে তখন এমন জলাবদ্ধতা দেখা দেয়।
নদী তো ছোট দৈর্ঘ্যের প্রবাহ নয়। নদী দীর্ঘ প্রবাহের হয়ে থাকে। এই নদী চলার পথে উজানে কোনো একটি স্থানে যখন পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করা হয়, তখনই নদীর প্রবাহ ভাটিতে কমে যেতে শুরু করে। পানির প্রবাহ ভাটিতে যখন কমে যেতে শুরু করে, তখন নদী ভরাট হতে থাকে। দু’পারের মানুষ ক্রমে নদী দখলের মহোৎসবে মেতে ওঠে। আমাদের সড়কের ওপর অসংখ্য বক্স কালভার্ট আছে। ছোট-মাঝারি মিলিয়ে এই সংখ্যা নেহাত কম নয়। একটু খুঁজলেই দেখা যাবে পানি নেমে যাওয়ার জন্য যেসব সংযোগ স্থাপন করা হয়েছিল তার অধিকাংশই অচল-অকেজো। এগুলো অকেজো হয়ে থাকায় আগে বৃষ্টির যত পানি নদীতে নেমে যেত এখন আর সেই পরিমাণ পানি নেমে যায় না। বৃষ্টির পানি নদী পর্যন্ত পৌঁছানোর জন্য পথে কৃত্রিম বাধা তৈরি করা হয়ে থাকে। ফলে আগে নদীতে বর্ষার যত পানি গিয়ে পড়ত এখন আর সেটি হয় না।
যে পানি নদীতে নেমে গিয়ে নদীকে বাঁচিয়ে রাখার কথা সেই পানিতেই জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। প্রধানত দুটি কারণে এই জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। অনেক সময় নদীর মূল প্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা হলে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। কখনও ব্রিজ-কালভার্টের উজানে ভাটিতে সংযোগ ঠিক না থাকার কারণে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। প্রাকৃতিক নিয়ম হচ্ছে বৃষ্টি যেখানেই হোক না কেন, সেই প্রবাহ কোনো না কোনোভাবে নদীর সঙ্গে যুক্ত হবেই। এই প্রাকৃতিক বাস্তবতাকে ধ্বংস করার কারণে নদীও যেমন হারাচ্ছে পানি, তেমনি স্বল্প বৃষ্টিতেও সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক জলাবদ্ধতা।
উজানের দেশ ভারতের সঙ্গে তালিকাভুক্ত ৫৪টি বাদ দিলে আরও অর্ধশতাধিক নদী আছে, যেগুলো বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন নদী। উজানে যেসব নদীর পানি ভারত একতরফা প্রত্যাহার করে সেগুলোও বাংলাদেশ অংশে মরে যাচ্ছে। এ নদী ব্যবস্থাপনার জন্য রাষ্ট্রীয় তৎপরতা যেটুকু থাকা জরুরি সেটুকু আমরা দেখছি না।
সেচ প্রকল্প নদীকে মেরে ফেলতে পারে। এর একটি উদাহরণ তিস্তা নদী। শুস্ক মৌসুমে ভারত একতরফা পানি প্রত্যাহার করে। মাটির তলদেশের পানিপ্রবাহে যেটুকু পানি নদীতে চলে আসে সেটুকু আবার নীলফামারী-লালমনিরহাটের দোয়ানি নামক স্থানে ব্যারাজ দিয়ে আটকে রেখে উজানে চাষাবাদ করা হয়। ফলে ভাটিতে যে ৭০ কিলোমিটার নদী আছে সেই নদীর আর কোনো প্রাণ থাকে না। বর্ষায় প্রাণ পায় বটে, তবে নদী শুকিয়ে যাওয়ার কারণে তলদেশ শক্ত হয়ে যায়, আর তখন গভীরতা তৈরি করার পরিবর্তে আরও দ্রুত ভরাট হচ্ছে নদী। ফল হিসেবে আমরা প্রতিবছরের তুলনায় প্রতিবছর বন্যা বেশি পরিমাণেই দেখতে পাচ্ছি।
রাবার ড্যামের মাধ্যমে নদীর সর্বনাশ করা হচ্ছে। আমাদের দেশে শুস্ক মৌসুমে নদীগুলোর কোনোটাতেই আর পর্যাপ্ত পানি থাকে না। যে সামান্য পানি থাকে সেটুকু আটকে রেখে যখন উজানে সেচ কাজ চালানো হয়, তখন রাবার ড্যামের ভাটির অংশে একেবারেই মৃত্যু রচিত হচ্ছে। দিনাজপুরের কাঁকড়া-আত্রাই নদীর ওপর দুটি রাবার ড্যামের দিকে তাকালেই এটি সহজে প্রতীয়মান হবে।
নদী রক্ষার জন্য পানির প্রবাহ এবং নদীর পানির সব উৎস বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। কৃত্রিমভাবে বাঁধ নির্মাণ করে নদীর পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করার নামে নদীমৃত্যুর কারণ বন্ধ করা জরুরি। অভিন্ন নদীতে অভিন্ন অধিকার আমাদের। সুতরাং উজানের নদীর পানি যাতে ভারত একতরফা প্রত্যাহার করতে না পারে সে বিষয়েও সরকারকে সচেষ্ট থাকতে হবে। দখলদারদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তির ব্যবস্থা করা হয় না। যারা নদী দখল করে শুধু উচ্ছেদ করাকে শাস্তি জ্ঞান করা হয়। এটি ঠিক নয়। আমরা মনে করি যিনি নদী দখল করেছেন আগে তার বিরুদ্ধে শক্ত আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নদীর ক্ষতি অর্থমূল্যে যেটি হয়, সেই অর্থ তার কাছ থেকে আদায় করতে হবে। দখলদারের মাধ্যমেই নদী মুক্ত করতে হবে।
লেখকবৃন্দ নদী সুরক্ষা বিষয়ক নাগরিক সংগঠন, রিভারাইন পিপলের সঙ্গে যুক্ত
Leave a Reply