জীবনের মাত্র আটাশ বছর যাপন করেছিলেন। এরই মধ্যে ঝুড়িতে জমা হয় অসংখ্য পুরস্কার আর স্বীকৃতি। তারপর! তারপর বিমানের ভেতর থেকে চূড়ান্ত বিপদ সংকেত (মে ডে) দিয়ে হঠাৎ করেই বলে উঠলেন, ‘আমি আর কয়েক মিনিট বেঁচে আছি পৃথিবীতে। আমরা হয়তো আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছি।’ কী ভয়ংকর বার্তা! স্বপ্নের চূড়ান্ত রেখার কাছাকাছি পৌঁছেও নির্মম এ বার্তা দেওয়ার পনেরো মিনিটের মধ্যেই বৈমানিক ফারিয়া লারা আলিঙ্গন করেন মৃত্যুকেই। আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্নই কাল হয় বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল নক্ষত্র সেলিনা হোসেনের কন্যা ফারিয়া লারার। ১৯৯৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মাত্র আটাশ বছর বয়সে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রশিক্ষক বৈমানিক ফারিয়া লারা সেসনা-১৫০ বিমান দুর্ঘটনায় ঢাকার অদূরে পোস্তগোলায় অকালেই ঝরে যান। তিনি একা নন, মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান লারার সহকর্মী রফিকুল ইসলাম সুমনও।
বরেণ্য কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন ও মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খানের কন্যা বৈমানিক ফারিয়া লারা বেঁচে থাকলে এখন তার বয়স হতো পঞ্চাশ বছর। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! আটাশ বছরেই পাড়ি জমাতে হয়েছে অন্তিম ঠিকানায়। বাংলাদেশের তারুণ্য ও নারীর এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক ফারিয়া লারাকে হারিয়ে মা সেলিনা হোসেনের চোখের জল শুকিয়ে গেছে বহু আগেই। দগদগে ক্ষত হৃদয় নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। শুধু বেঁচেই আছেন এমন নয়, শোককে শক্তিতে পরিণত করে সেলিনা হোসেন সৃষ্টি করে চলছেন একের পর এক কালজয়ী সাহিত্যকর্ম।
ফারিয়া লারা স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন মানুষকে। বুকের ভেতর জিইয়ে রেখেছিলেন সহায়-সম্বলহীন মানুষের মুখে হাসি ফোটার নানা বাসনা। ইংরেজি সাহিত্যের এই মেধাবী শিক্ষার্থীর স্বপ্ন ছিল আকাশে পাখির মতো ভেসে বেড়ানোর। সেই স্বপ্ন পূরণও হয়েছিল। বেশি দিন টেকেনি। অকালে চলে যাওয়া লারা স্বপ্ন দেখতেন সুন্দর ও কল্যাণের। তার মৃত্যুর পর সেই স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে সেলিনা হোসেন ও আনোয়ার হোসেন খান সহায়-সম্বলহীন মানুষকে সেবাদানের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন লারা ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন। দুই দশক ধরে সংগঠনটি কাজ করছে আর্তমানবতার সেবায়।
ফারিয়া লারা ছিলেন তীক্ষষ্টধীসম্পন্ন, সাহসী, নিজ পরিচয়ে প্রতিষ্ঠা লাভে তার সময়ে অগ্রণী। ছবি আঁকা, অভিনয়, গল্পবলা, আবৃত্তি আর বিতর্কে লারা তার প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। অর্জন করেছেন প্রশংসা ও নানা পুরস্কার। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী হয়েও অধ্যাপনা, গবেষণা বা প্রথাগত কোনো চাকরি না করে বৈমানিকের দুঃসাহসী পেশা বেছে নিয়ে ছিলেন। ফারিয়া লারা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ কর্তৃক প্রাইভেট পাইলটস লাইসেন্স এবং কমার্শিয়াল লাইসেন্স অর্জন করেন। তারপর প্রশিক্ষক হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ফ্লাইং শেষ করে এনেছিলেন। লারাই ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রশিক্ষক। স্বপ্নকে স্পর্শ করার জন্য সেদিন লারা আকাশে উড়ে ছিলেন। মাটিতে ফেরেন লাশ হয়ে। স্বপ্ন পূরণের মাত্র দুই মিনিট আগে সেদিন ১০টা ২৩ মিনিটে সেসনা-১৫০ বিধ্বস্ত হয়। তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে ছোঁয়ার কথা ছিল ১০টা ২৫ মিনিটে। কন্ট্রোল টাওয়ারে লারা মে ডে পাঠিয়ে ছিলেন। তারপরই যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এভাবেই ফারিয়া লারা আর সুমন বিচ্ছিন্ন হয়ে যান তাদের স্বপ্ন থেকে।
বিমান দুর্ঘটনায় ফারিয়া লারার মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন মা সেলিনা হোসেন ও বাবা আনোয়ার হোসেন খানের কাছে। সেই শোকবার্তায় শেখ হাসিনা শান্তি কামনাও করেন লারার জন্য।
লারা শেষ হয়ে যাননি, লারা শেষ হতে পারেন না। তিনি বেঁচে আছেন এ দেশের লাখো মানুষের হৃদয়ে, বেঁচে আছেন তার দেখা স্বপ্নের ভেতর। এই প্রয়াণ দিবসে গভীর শ্রদ্ধা ফারিয়া লারা ও রফিকুল ইসলাম সুমনের প্রতি।
Leave a Reply