বিশ্বব্যাপী প্রবহমান মহামারি করোনা যে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর জন্য অশনিসংকেত—এ কথা তাবত্ তথ্য পরিসংখ্যানে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। আসন্ন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কালে মানুষ আর মেশিনের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের, অস্তিত্বের ও টেকসই অবস্থানের যে ঠাণ্ডা লড়াই চলবে, সেখানে প্রবীণ নয়, নবীনদের প্রযুুক্তি জ্ঞান হবে অন্যতম নিয়ামক। করোনার কর্মপরিকল্পনার রেখচিত্র ও উদ্দেশ্য-বিধেয় বুঝতে বাকি থাকছে না কারো।
বার্ধক্য হলো জীবনচক্রের শেষ ধাপ। জীবনের নাজুক ও স্পর্শকাতর অবস্থা! বেঁচে থাকলে প্রত্যেক মানুষকে বার্ধক্যের সম্মুখীন হতেই হবে। বার্ধক্য মানে শারীরিক অবস্থার অবনতি। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অভিজ্ঞতা বাড়লেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পায়। দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও হজমশক্তি লোপ পায়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে না। রক্তচাপ ও হার্টের সমস্যা দেখা দেয়। দুর্বল স্বাস্থ্য আর উপার্জনহীন একজন প্রবীণ সবার কাছে অবহেলিত, উপেক্ষা ও দুর্ব্যবহারের শিকার। তাঁদের ভরণ-পোষণ, সেবা-যত্ন, চিকিৎসা ও আবাসন সমস্যা দেখা দেয়। প্রবীণদের অনেকে বুঝতে চান না। তাঁদের কল্যাণে কাজ করতেও চান না। হতাশা, বিষণ্নতা ও নিঃসঙ্গতায় চলে প্রবীণদের জীবন। প্রবীণ সেবাসূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৭তম।
প্রবীণদের সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত (৪৫/১০৬) জাতিসংঘের। এবারে এ দিবস পালনের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘টুওয়ার্ডস এ সোসাইটি ফর অল এজেস’, ‘সমাজ হবে সব বয়েসি সকলের’। এই প্রতিপাদ্য বা স্লোগান এর আগে ১৯৯৮ সালেও উচ্চারিত হয়েছিল। ২২ বছরের ব্যবধানে একই স্লোগান পুনঃ উচ্চারণের দ্বারা বয়স-নির্বিশেষে সবার জন্য নির্মিত সমাজে প্রবীণদের সুরক্ষা ও তাঁদের অধিকারের সর্বজনীন স্বীকৃতির প্রত্যয় পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। প্রসঙ্গত যে ২০০২ সালে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ১৫৯টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রবীণ বিষয়ক দ্বিতীয় বিশ্ব সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনা ও রাজনৈতিক ঘোষণা গৃহীত হয়। এতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে ‘সব বয়সীর জন্য উপযুক্ত একটি সমাজ নির্মাণে উন্নয়নের অধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও সব ধরনের মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন।’
মাদ্রিদ সম্মেলনের ঘোষণায় ১২টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়—১. সব প্রবীণ নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন, ২. নিরাপদ বার্ধক্য অর্জন, প্রবীণ বয়সে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং প্রবীণদের জন্য জাতিসংঘ নীতিমালা বাস্তবায়ন, ৩. নিজেদের সমাজে স্বেচ্ছামূলক ও আয়বর্ধকমূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাপনে পরিপূর্ণ এবং কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রবীণদের ক্ষমতায়ন, ৪. জীবনব্যাপী এবং শেষ জীবনেও সচ্ছল, আত্মপরিতৃপ্তি ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে, ৫. প্রবীণরা কোনো একক সমজাতীয় বর্গ নয়, বিষয়টি স্বীকার করে তাঁদের জীবনব্যাপী শিক্ষা ও কমিউনিটি অংশগ্রহণের সুযোগ, ৬. প্রবীণরা যেন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার, ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত এবং তাঁদের বিরুদ্ধে সব বৈষম্য ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে, ৭. জেন্ডারকেন্দ্রিক বৈষম্য দূর করে প্রবীণদের মধ্যে জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার, ৮. সামাজিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সংহতি, আন্ত প্রজন্ম নির্ভরশীলতা ও পরিবারে স্বীকৃতি প্রদান, ৯. প্রতিরোধ ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা, সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ থাকা, ১০. প্রবীণদের প্রাইভেট সেক্টর, সিভিল সোসাইটি ও সরকারের সব মহলের মধ্যে অংশীদারি গড়ে তোলার সহযোগিতা, ১১. উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অন্যান্যের মধ্যে বার্ধক্যের ব্যক্তিকর, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়াগুলোকে কেন্দ্র করে যন্ত্রপাতি আবিষ্কারসহ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে উৎসাহ প্রদান, ১২. আদিবাসী প্রবীণদের বিশেষ পরিস্থিতি ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় রেখে তাঁদের বক্তব্য কার্যকরভাবে প্রকাশের সুযোগ দেওয়া।
সম্মেলনে তিনটি নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয়—
ক. প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন, খ. প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও সচ্ছলতা বৃদ্ধি, গ. প্রবীণদের জন্য সক্ষমতা ও সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা। সম্মেলনে ২৩৯টি সুপারিশ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। বিশ্ব প্রবীণ দিবসে বিশ্বব্যাপী যাবতীয় কর্মসূচি এই নির্দেশনা ও সুপারিশমালা বাস্তবায়নের ফলাবর্তনকে কেন্দ্র করে সূচিত হয়।
প্রবীণ নীতিমালা মতে, ৬০ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সের ব্যক্তিকে প্রবীণ হিসেবে গণ্য করা হয়। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী জন্মের পর বাংলাদেশের গড় আয়ু হচ্ছে ৭০.০৬ বছর। এর মধ্যে পুরুষদের আয়ু ৭০.০৬ বছর, নারীর ৭১.৯৮ বছর। আর ৬০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ মানুষ বসবাস করছে। এঁদের কেউ কেউ ১০০ বছরের মতো বয়সের দীর্ঘ জীবনযাপন করছেন। এর মধ্যে নারী প্রবীণরা দীর্ঘজীবী হলেও তাঁদের বেশির ভাগই মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য হন। এ দুঃসহ জীবনযাপন শুধু অসহায়ত্ব ও দুর্ভাগ্যজনক ছাড়া আর কিছু নয়।
বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের সব অসুবিধাগ্রস্ত শ্রেণিকে সহায়তা প্রদানের নিশ্চয়তার বিধান রয়েছে। সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের দায়িত্ব হলো সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা; কর্মের অধিকার অর্থাত্ কর্মের গুণ ও পরিমাণ বিবেচনা করে যুক্তিসংগত মজুরির বিনিময়ে কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তার অধিকার; যুক্তিসংগত বিশ্রাম, বিনোদন ও অবকাশের অধিকার এবং সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার। এরই আলোকে প্রবীণদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্র্যমুক্ত, কর্মময়, সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করতে ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়। মোট ২০টি অনুচ্ছেদসংবলিত এ নীতিমালায় দেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। জাতীয় প্রবীণ নীতিমালার ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে প্রবীণ ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে সরকার উৎসাহিত করবে মর্মে উল্লেখ রয়েছে।
কালের প্রবাহে আবর্তিত মানবজীবনকাল স্থির নয়। আজকের প্রবীণ একদিন নবীন ছিলেন। বর্তমান নবীনই ভবিষ্যতের প্রবীণ। প্রবীণরাই নবীনদের জন্ম দিয়েছেন, প্রতিপালন করে বড় করেছেন; আর এভাবেই গড়ে উঠেছে এই সমাজ ও সভ্যতা। পূর্ণাঙ্গতা বা সম্পূর্ণতায় মানবজীবনযাত্রার সূচনা হয় না; বরং মাতৃগর্ভ বা মাতৃকোল থেকে সুনিবিড় পরিচর্যা, পরম স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার মাধ্যমে মানুষের বেড়ে ওঠা। মানবের সুনাম, সুখ্যাতি, আদর্শিক ও আলোকিত হওয়ার ক্ষেত্রে অনন্য অবদান তাঁদের, যাঁরা আজ প্রবীণ। তাঁদের জীবন উত্সর্গিত আত্মসমৃদ্ধির জন্য নয়, বরং প্রজন্মের সমৃদ্ধির প্রত্যাশায়। বর্তমানের সাফল্য ও সব অর্জনের মধ্যে আছে প্রবীণের অস্তিত্ব। তাই তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, মমতা ও সেবার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা যায় প্রবীণের অধিকার।
এটা অনস্বীকার্য, বিভিন্ন কারণে প্রবীণরা আজ অবহেলার শিকার। আজকাল যৌথ পরিবার ভেঙে এক দম্পতির পরিবার অধিক জনপ্রিয় হওয়ার কারণ একটি। আর দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে প্রবীণরা উপার্জন করতে পারেন না; কিন্তু উপার্জন করতে না পারলেও তাঁরা পরিবারে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন, এটা সবার বোঝা উচিত। স্বাস্থ্যসেবায় প্রবীণদের অগ্রাধিকার দিতে, আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ করতে, সন্তানের ভুলগুলো আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা রাখতে এবং যৌথ পরিবার রক্ষায় রাষ্ট্রকে অনেক কিছু করতে হবে। নানা-নানি, দাদা-দাদি, যিনিই হোন না কেন, সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করতে হবে। বদলে ফেলতে হবে দৃষ্টিভঙ্গি, তাহলেই বদলে যাবে সমাজ। সমাজে ফুরফুরে মেজাজে প্রবীণরা শক্তি হয়ে থাকবেন। প্রবীণ সেবাই হোক আজকের অঙ্গীকার।
লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান । mazid.muhammad@gmail.com
Leave a Reply