জার্মান সরকারের দ্বিতীয় টিভি চ্যানেল ZDF-এর এক প্যানেল আলোচনায় শুনলুম, বলছেন একজন, ‘করোনাভাইরাসে বিশ্বে যত লোক মারা যাবে—সংখ্যা কত, বলা অসম্ভব—তার চেয়ে দ্বিগুণ বাড়বে।’
কেন? আরেকজন আলোচকের প্রশ্ন।
বললেন, ১৯৭৪ সালে পেট্রলের দাম হঠাৎ-ই বেড়ে যায়, দাম প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে, জোগান অল্প, ‘ওপেক’-এর জেদ ব্যারলপ্রতি চারগুণ দিতে হবে। তেলের হাহাকার তখন। মার্কিন সরকার ঠিক করেন, পরিস্থিতি সামাল না-দেওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে দুই দিন কাজ, বাকি পাঁচ দিন অফিস, কারখানা বন্ধ। কমিউনিস্ট দেশ বাদে, ইউরোপের কিছু দেশে, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সেও আংশিক ঘটনা। এই নির্দেশ, এই বন্ধ এক অর্থে লকডাউন। আমেরিকা, ইউরোপে তখন জনসংখ্যা বেড়েছিল। করোনাভাইরাসে বিশ্বব্যাপী লকডাউন। জন্মহার বৃদ্ধি পেলে আশ্চর্য হবো না।’
রসিকতাচ্ছলে বলা নিশ্চয়, কিন্তু এও হুঁশিয়ারি, ‘বহু দেশ গরিব থেকে গরিবতর হবে, মুখ থুবড়ে পড়বে, মানুষ অনাহারে মরবে সামাল দেওয়া কঠিন। দেশে-দেশে উদ্বাস্তুর ঢল নামবে, করোনার চেয়েও বিপদ ঘনতর হবে। এবং বিপদ আসন্ন।’
গ্রিন পার্টির একজন ভিন্ন প্রসঙ্গ তোলেন। বলেন, ‘করোনার প্রহারে দূষণ কমতি, প্রকৃতি সামান্য হলেও সুস্থ।’
করোনা নিয়ে তাবৎ মিডিয়া মশগুল। যেন আর কোনও খবর নেই। এও বাহ্য। ফেসবুক, টুইটারও সয়লাব। দেখাসাক্ষাৎ বাদ, ফোনে কেবল করোনার কথা।
আশংকা করা হচ্ছে, বিস্তর সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কোনও বিজ্ঞাপন নেই। বিক্রিও সামান্য।
সংবাদপত্র, টিভি (বিশেষত কমারশিয়াল, অধিকাংশই কমারশিয়াল।) বিজ্ঞাপন নির্ভরশীল। ইতিমধ্যেই কর্মী ছাঁটাই। বেতনও হ্রাস। হোটেল, রেস্তোরাঁর নাভিশ্বাস। বন্ধ হচ্ছে। ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও।
‘করোনায় বেকারত্ব বাড়বে গোটা দুনিয়ায়’, বলছে সব অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক, সমাজকর্মী। বন্ধ হবে সাহায্যপ্রাপ্ত বহু এনজিও। ত্রাহি মধুসূদন চারদিকে।
যারা প্রবাসী, তাঁদের উৎকণ্ঠা দেশ, বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন নিয়ে। একই দুঃশ্চিন্তা বিদেশে বসবাসরত সন্তান, আত্মীয়কুল নিয়ে বাবা-মায়ের, জ্ঞাতিবর্গের। দিনমান ফোন আর ফোন। কুশলাদি জিজ্ঞাসা। এপক্ষ ওপক্ষের কানে কেবলই সাবধানতার বাণী। ছাড়াছাড়ি হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকার।
জার্মানির বহুল প্রচারিত দৈনিক (সাড়ে তিন মিলিয়ন প্রচার সংখ্যা। করোনায় বিক্রি কমে এখন দেড় মিলিয়নের কম) ‘বিল্ড’ জানাচ্ছে, করোনার কারণে ১. বাচ্চা ছেলেমেয়ে বাড়িতে থেকে লেখাপড়ায় মনোযোগী। ২. দুষ্টামি কমেছে। বাবা-মায়ের বাধ্য। ৩. লোকে খেয়েদেয়ে মোটা হচ্ছে। ৪. পানীয়-বিয়ার-ওয়াইন খাওয়া বেড়ে গেছে। ৫. স্বামী-স্ত্রী সংসার ও সন্তান প্রতিপালনে যত্নশীল। ৬. স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া নিত্যবেলায়। ৭. পরকীয়া প্রেম বাদ। ৮. পর্নো দেখা বেড়ে গেছে। ৯. গত সত্তর বছরে ক্রাইম (চুরিচামারি-খুন-ডাকাতি-রাহাজানি), দুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য হ্রাস। ১০. ডিস্কো নেই, যৌনকর্মী নেই, পতিতালয় বন্ধ। আরো ফিরিস্তি আছে।
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার এখন জীবনসঙ্গী। নানা রঙ্গরসিকতায় মেতে আছে। কবিতা-গান-সিনেমা নাটকের মায় রাজনৈতিক নেতানেত্রীর সংলাপ নিয়ে হরেকরকম প্যারোডি। কার্টুন।
ZDF -এর ‘কুলটুর’ অনুষ্ঠানে শুনলুম, মহামারি (প্লেগ) নিয়ে লেখা গল্প-কাহিনি-কাব্য-উপন্যাসের বিক্রি বেড়ে গেছে।
প্যারিস থেকে সুলেখিকা আনা ইসলাম (শিল্পী শাহাবুদ্দীনের স্ত্রী) রসিকতা করেন টেলিফোনে, ‘এবছর ঈদ-পুজো সংখ্যায় হয়তো করোনা নিয়ে বিস্তর গল্প-কবিতা-উপন্যাস লেখা হবে।’
কলকাতা থেকে নূপুর বিশ্বাস টেলিফোনে জানান, ‘আমার স্বামী দীপক বিশ্বাস ঘরের খড়কুটোও সরাতেন না। কাজের মাসি উধাও। এখন তিনি সকালে উঠে আমার জন্যে চা করেন। সবই করোনার মহিমা।’
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
দাউদ হায়দার
জার্মান সরকারের দ্বিতীয় টিভি চ্যানেল ZDF-এর এক প্যানেল আলোচনায় শুনলুম, বলছেন একজন, ‘করোনাভাইরাসে বিশ্বে যত লোক মারা যাবে—সংখ্যা কত, বলা অসম্ভব—তার চেয়ে দ্বিগুণ বাড়বে।’
কেন? আরেকজন আলোচকের প্রশ্ন।
বললেন, ১৯৭৪ সালে পেট্রলের দাম হঠাৎ-ই বেড়ে যায়, দাম প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে, জোগান অল্প, ‘ওপেক’-এর জেদ ব্যারলপ্রতি চারগুণ দিতে হবে। তেলের হাহাকার তখন। মার্কিন সরকার ঠিক করেন, পরিস্থিতি সামাল না-দেওয়া পর্যন্ত সপ্তাহে দুই দিন কাজ, বাকি পাঁচ দিন অফিস, কারখানা বন্ধ। কমিউনিস্ট দেশ বাদে, ইউরোপের কিছু দেশে, জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সেও আংশিক ঘটনা। এই নির্দেশ, এই বন্ধ এক অর্থে লকডাউন। আমেরিকা, ইউরোপে তখন জনসংখ্যা বেড়েছিল। করোনাভাইরাসে বিশ্বব্যাপী লকডাউন। জন্মহার বৃদ্ধি পেলে আশ্চর্য হবো না।’
রসিকতাচ্ছলে বলা নিশ্চয়, কিন্তু এও হুঁশিয়ারি, ‘বহু দেশ গরিব থেকে গরিবতর হবে, মুখ থুবড়ে পড়বে, মানুষ অনাহারে মরবে সামাল দেওয়া কঠিন। দেশে-দেশে উদ্বাস্তুর ঢল নামবে, করোনার চেয়েও বিপদ ঘনতর হবে। এবং বিপদ আসন্ন।’
গ্রিন পার্টির একজন ভিন্ন প্রসঙ্গ তোলেন। বলেন, ‘করোনার প্রহারে দূষণ কমতি, প্রকৃতি সামান্য হলেও সুস্থ।’
করোনা নিয়ে তাবৎ মিডিয়া মশগুল। যেন আর কোনও খবর নেই। এও বাহ্য। ফেসবুক, টুইটারও সয়লাব। দেখাসাক্ষাৎ বাদ, ফোনে কেবল করোনার কথা।
আশংকা করা হচ্ছে, বিস্তর সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কোনও বিজ্ঞাপন নেই। বিক্রিও সামান্য।
সংবাদপত্র, টিভি (বিশেষত কমারশিয়াল, অধিকাংশই কমারশিয়াল।) বিজ্ঞাপন নির্ভরশীল। ইতিমধ্যেই কর্মী ছাঁটাই। বেতনও হ্রাস। হোটেল, রেস্তোরাঁর নাভিশ্বাস। বন্ধ হচ্ছে। ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও।
‘করোনায় বেকারত্ব বাড়বে গোটা দুনিয়ায়’, বলছে সব অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক, সমাজকর্মী। বন্ধ হবে সাহায্যপ্রাপ্ত বহু এনজিও। ত্রাহি মধুসূদন চারদিকে।
যারা প্রবাসী, তাঁদের উৎকণ্ঠা দেশ, বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন নিয়ে। একই দুঃশ্চিন্তা বিদেশে বসবাসরত সন্তান, আত্মীয়কুল নিয়ে বাবা-মায়ের, জ্ঞাতিবর্গের। দিনমান ফোন আর ফোন। কুশলাদি জিজ্ঞাসা। এপক্ষ ওপক্ষের কানে কেবলই সাবধানতার বাণী। ছাড়াছাড়ি হচ্ছে প্রেমিক-প্রেমিকার।
জার্মানির বহুল প্রচারিত দৈনিক (সাড়ে তিন মিলিয়ন প্রচার সংখ্যা। করোনায় বিক্রি কমে এখন দেড় মিলিয়নের কম) ‘বিল্ড’ জানাচ্ছে, করোনার কারণে ১. বাচ্চা ছেলেমেয়ে বাড়িতে থেকে লেখাপড়ায় মনোযোগী। ২. দুষ্টামি কমেছে। বাবা-মায়ের বাধ্য। ৩. লোকে খেয়েদেয়ে মোটা হচ্ছে। ৪. পানীয়-বিয়ার-ওয়াইন খাওয়া বেড়ে গেছে। ৫. স্বামী-স্ত্রী সংসার ও সন্তান প্রতিপালনে যত্নশীল। ৬. স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া নিত্যবেলায়। ৭. পরকীয়া প্রেম বাদ। ৮. পর্নো দেখা বেড়ে গেছে। ৯. গত সত্তর বছরে ক্রাইম (চুরিচামারি-খুন-ডাকাতি-রাহাজানি), দুর্ঘটনার উল্লেখযোগ্য হ্রাস। ১০. ডিস্কো নেই, যৌনকর্মী নেই, পতিতালয় বন্ধ। আরো ফিরিস্তি আছে।
ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার এখন জীবনসঙ্গী। নানা রঙ্গরসিকতায় মেতে আছে। কবিতা-গান-সিনেমা নাটকের মায় রাজনৈতিক নেতানেত্রীর সংলাপ নিয়ে হরেকরকম প্যারোডি। কার্টুন।
ZDF -এর ‘কুলটুর’ অনুষ্ঠানে শুনলুম, মহামারি (প্লেগ) নিয়ে লেখা গল্প-কাহিনি-কাব্য-উপন্যাসের বিক্রি বেড়ে গেছে।
প্যারিস থেকে সুলেখিকা আনা ইসলাম (শিল্পী শাহাবুদ্দীনের স্ত্রী) রসিকতা করেন টেলিফোনে, ‘এবছর ঈদ-পুজো সংখ্যায় হয়তো করোনা নিয়ে বিস্তর গল্প-কবিতা-উপন্যাস লেখা হবে।’
কলকাতা থেকে নূপুর বিশ্বাস টেলিফোনে জানান, ‘আমার স্বামী দীপক বিশ্বাস ঘরের খড়কুটোও সরাতেন না। কাজের মাসি উধাও। এখন তিনি সকালে উঠে আমার জন্যে চা করেন। সবই করোনার মহিমা।’
লেখক: কবি ও সাংবাদিক
Leave a Reply