ভারতের আসামে কারাগার থেকে দেশে ফেরা ২৬ জেলে পরিবারকে গত আগস্টে ত্রাণ সহায়তা দেওয়ার সময় প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘আর কোথাও যেতে হবে না- চিলমারীতে শিপইয়ার্ড হবে। এখানেই কাজের ব্যবস্থা হবে।’ বললে ভালো হতো যে, নদীকে আপনাদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। নদীতে কেউ উপদ্রব করবে না। জেলেরা কেন যান? মাছ শিকারে। শত শত বছর ধরে তারা মাছ শিকার করেন। যারা বিএ এমএ পাস করেন, তারাও মাছ ধরতে যান। মাছের নেশা এক অদ্ভুত নেশা। মাছ শিকারের জন্য মাছের স্বভাব জানতে হয়। গভীর পানির মাছকে ধরতে গেলে কয়েক পুরুষের জ্ঞান লাগে। লাগে দক্ষতাও। মাছের সঙ্গে জেলের সম্পর্ক শুধু শিকার ও শিকারির নয়। পরস্পরের টিকে থাকা ও টিকিয়ে রাখারও। ওই ২৬ জেলের মধ্যে দু’জন হানিফ ও মানিকের বাপ লাল মিয়া (৬২) বলেন- ‘এখানে মাছের আরাম করার জায়গা নাই। মাছের ঘুমানির জায়গা নাই, ডিম পাড়ার জায়গা নাই। সকালে এক দল যেখানে গিয়ে মাছ মারি আসে, রাতে আরেক দল সেখানে গিয়ে মাছ মারে।’
আটক এছানুলের বাবা আ. শহীদ (৬০) বলেছিলেন- ‘মাছের খাবার লাইগবে না? নদীত তো খাবার কমি গেইছে।’ তিনি আরও বলেন, আসামে ব্রহ্মপুত্রের মধ্যে বিশাল বিশাল বন আছে। সেখানে সারাবছর পানি থাকে কম-বেশি। নদীর মাছ ওখানে ঢুকলে মাছ নিরাপদ। বনের মধ্যে মাছ ধরা নিষেধ। যখন প্লাবনে বন আর নদী একাকার হয়ে যায়, তখন পানির সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ নেমে আসে। আমাদের এখানে বন কোথায়?
২. নদী তুমি কার? প্রশ্নটা রেখেছিলেন কুড়িগ্রামের সন্তান সব্যসাচী লেখক সৈয়দ হক। জেলেরা মাঝনদীতে কোলা (নদীর মাঝখানের হ্রদ) পড়লে সেখানে মাছ ধরেন না। নদনদীর মাছ এসব কোলায় গিয়ে ডিম ছেড়ে আসে। কিন্তু কোলার মালিকানা দাবি করেন জমিওয়ালা কিংবা প্রভাবশালীরা। যখন কোলা জেগে ওঠে, তখন প্রভাবশালীরা এই কোলাগুলো লিজ নেন। তারপর বিশেষ ধরনের জাল দিয়ে ছেঁকে নেন। ফলে মাছের ডিম তো দূরে থাক, শ্যাওলাগুলো পর্যন্ত চলে আসে। কেউ কেউ আবার বিষ দেন। ফলে গভীর গর্তে থাকা গতা, বাইম, কাঁকড়াসহ পোকামাকড় পর্যন্ত উঠে আসে। এক ভয়াবহ ঘটনা।
আসাম ফেরত ইউনুছ মিয়া (৪০) বলেন, ভারতে এই কোলাগুলোতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ। কোলাগুলো হলো সংরক্ষিত এলাকা। এই কোলাগুলোতে মাছ ডিম পেড়ে আসে। তারপর পানি বাড়লে তখন কোলার মাছ নদীর সঙ্গে মিশে যায়। বড় হয়। তার মতে- ‘কোলা হইল মাছের ঘর, আর নদী হইল তার হাটবাজার। প্রভাবশালীরা তো মাছের ঘরত যায়া মাছ ধইরতেছে। দুনিয়াত মাছ থাকে কেমন করি?’
নদীর খাসজমিতে দখল নেন প্রভাবশালীরা। ভূমি অফিসে গিয়ে হয়ে যান ভূমিহীন। খাসজমিতে ঘরের নিশানা রাখেন, আর আবাদ করেন রেকর্ডীয় জমিতে। চরের জমিতে দু’বছর হাল না দিলেই প্রাকৃতিক বন গড়ে উঠবে। সেখানে প্রাকৃতিক বন গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া ঠেকিয়ে আবাদ করা হয়। কাশবন গড়ে উঠলে দখল চলে যায় কৃষক বা বাথান মালিকের কাছে। ফলে জেলেরা যাবেন কোথায়?
এ ছাড়া শুধু চিলমারীতেই বালু তোলার অর্ধশত ড্রেজার আছে। গড়ে উঠেছে ড্রেজার তৈরির কারবার। এখানকার বালি যাচ্ছে দেশের আনাচে-কানাচে। বালু উত্তোলনের কারণে মাছ-কাছিম-পাখি-অণুজীবের বাস্তুতন্ত্র ভেঙে পড়ছে। ফলে মাছ ধীরে ধীরে ‘নাই’ হয়ে যাচ্ছে। জেলেরা তাহলে কোথায় যাবেন? কোনটা সুবিধাজনক- ভিন্ন পেশায়, না মাছের প্রাচুর্য যেখানে?
৩. গত বছর সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ নদীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছেন। চলতি সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ সপ্তাহে পালিত হয়েছে ‘বিশ্ব নদী দিবস’। জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ সনদ-১৯৯৭ ভাটির দেশটির জন্য রক্ষাকবচ। কিন্তু কথা হচ্ছে, নদীর ওপর প্রথম হক কার?
নদীর স্বাস্থ্য যারা ধ্বংস করে, নদীর আবাস যারা ধ্বংস করে, তারা ক্ষমতার অংশ। আর নদীর হকদার জেলে, এই হকদারের হক বা অধিকার যার খেয়ে ফেলে তাদের উচ্ছেদ না করলে, জেলেরা মাছের সন্ধানে ছুটবেনই। পাখি যেমন সাইবেরিয়া থেকে আসে, তারাও ছুটবেন তা আসাম হোক কিংবা যে কোথাও হোক। ওদিকে ওরা বালুর ব্যবসা করুক, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে নিজেরা টাকার পাহাড় জমাক। বায়ু দূষিত করে বালুর টাকায় হাসপাতাল বানাক, আর আমরা সেই দূষিত বায়ু দিয়ে ফুসফুস ফুটো করে সেখানে ভর্তি হই। টাকা আর টাকা।
এই বাংলায় একদিন কৈবর্ত বিদ্রোহ হয়েছিল। কৈবর্ত মানে জেলে। মুক্তিযুদ্ধেও তারা ছিলেন। নৌকা তো এঁদেরই প্রতীক। মওলানা ভাসানীর প্রতীক ছিল নৌকা। বঙ্গবন্ধুর প্রতীকও নৌকা। দু’জনই ছিলেন বঞ্চিত মানুষের নেতা। এখন একদিকে ক্ষমতায় নৌকা, আরেকদিকে জেলেরা নৌকা ছাড়া হয়ে যাচ্ছেন। যে নৌকা ক্ষমতায়, তবে সে কোন নৌকা?
রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির সাবেক সভাপতি
nahidknowledge@gmail.com
Leave a Reply