মানুষ নিজেরাই নিজেদের ইতিহাস নির্মাণ করেন। মানব সভ্যতার ইতিহাস নির্মাণ করেছেন মানুষ নিজেই। বাংলাদেশের অভিবাসী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতিতে নিত্যনতুন ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। অপরদিকে শাসকশ্রেণি তার ইতিহাস নির্মাণ করে চলেছেন অভিবাসীদের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা আর দায়-দায়িত্বের প্রতি কোনোরূপ কর্ণপাত না করে। এরকম একটি পরস্পরবিরোধী অবস্থা বিরাজ করছে অভিবাসী শ্রমিক এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার মাঝে। এরকম একটি অসাম্য ব্যবস্থা দ্বারা কি দেশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারে?
যে অভিবাসী শ্রমিক তার জীবনের সোনালি সময় পরিবার, সমাজ রাষ্ট্রের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে নিজের আবেগ অনুভূতি আবেগ, ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলো, রাষ্ট্রের কি উচিত নয় তাদের বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা? রাষ্ট্র কি এই দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে? যদি না পারে তাহলে কেন সেই দায়িত্ব নিচ্ছে না বা নিলেও কেন সেটা অপ্রতুল? এই বিষয়গুলো জানতে হলে আমাদের জানতে হবে অভিবাসন সংক্রান্ত রাষ্ট্রীয় অঙ্গগুলো সম্পর্কে, রাষ্ট্রের অভিবাসন নীতি সম্পর্কে।
বাংলাদেশ শ্রমিক অভিবাসনের ক্ষেত্রে বিশ্বে অবস্থান পঞ্চম, বাংলাদেশের আগে অবস্থানকারী দেশগুলোর মধ্যে ভারত, চীন, মেক্সিকো উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ থেকে অভিবাসন শুরু হয় মূলত ১৯৭৬ সালে ২৭৬ জন দিয়ে, বর্তমানে বিশ্বের ১৬০টি দেশে প্রায় ১ কোটি ২৭ লাখ (বিভিন্ন সংস্থার দাবি ১ কোটি ৪০ লাখ)। এর মধ্যে নারী অভিবাসীর সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ, যার মধ্যে সৌদিতে অবস্থান করছে প্রায় ৩ লাখ নারী অভিবাসী। নারীর মতো পুরুষ অভিবাসীও সবচেয়ে বেশি সৌদিতে। প্রায় ৩৮ লাখ ৮৪ হাজার অভিবাসী সেখানে পাড়ি জমিয়েছে, যা মোট অভিবাসনের শতকরা ২৭ ভাগ। দ্বিতীয় অবস্থান সংযুক্ত আরব আমিরাত, সেখানে প্রায় ২৩ লাখ ৭০ হাজার পাড়ি জমিয়েছে, যা মোট অভিবাসনের শতকরা ১৯ ভাগ। এরপর ওমানে ১৪ লাখ ৭৭ হাজার, যুক্তরাজ্যে ১১ লাখ, যার মধ্যে ৯৫ ভাগ অভিবাসী সিলেট অঞ্চলের, মালয়েশিয়াতে ১১ লাখ, যুক্তরাষ্ট্রতে ১২ লাখ ৫০ হাজারের মতো, এছাড়া কুয়েত, কাতার, বাহারাইন, মালদ্বীপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, গ্রিস প্রভৃতি দেশে।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিবাসী রয়েছে ইতালিতে প্রায় ৩ লাখ (২০১৫ সালের তথ্য), এর পরের অবস্থান কানাডা, এছাড়া ব্রাজিলেও কিছু অভিবাসী আছে।
বৈধভাবে বিদেশ যাওয়া অভিবাসীদের হিসাব রাখা বাংলাদেশে সরকারের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এই সংস্থার কাছে বর্তমানে ঠিক কতজন মানুষ প্রবাসে আছে তার সঠিক কোনও হিসাব নেই! ১৯৭৬ সালে থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত কতজন মানুষ দেশে ফেরত আসলো তারও হিসাব নেই। এই হচ্ছে অভিবাসন নিয়ে কাজ করা সংস্থার কাজের নমুনা।
অতিমারি করোনাভাইরাস চীন থেকে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পর বিশ্বব্যাপী পুরো অর্থনীতির চিত্র পাল্টে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, তৎকালীন ৮২টি দেশ আংশিক/সম্পূর্ণ লকডাউন কার্যকর করে, যা এখন অবধি সম্পূর্ণ উঠানো হয়নি। যার ফলে হাজার হাজার শিল্পকারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়, বেকার হয়ে পড়ে লাখ লাখ শ্রমিক। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা-আইএলও বলছে, করোনা অতিমারির কারণে সারা বিশ্বে প্রায় ১৯ কোটি মানুষ কাজ হারাবে। এর মধ্যে এশিয়ায় কাজ হারাবে ২ কোটি মানুষ, আরব দেশগুলোতে ৫০ লাখ, এই প্রভাব পড়বে অভিবাসন খাতেও। বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, আরব ও এশিয়ার দেশগুলোতে চাকরিচ্যুতির মূল শিকার হবেন অভিবাসী শ্রমিকরা। সারা বিশ্বের ১৬০টি দেশের মোট অভিবাসীর ৭৫ ভাগের অবস্থান মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রায় ১০ ভাগ।
বাংলাদেশের শ্রমবাজার মূলত তিনটি—>উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ>মধ্যপ্রাচ্য >পূর্ব এশিয়া, এর মধ্যে প্রথম দুটির অবস্থা খুবই খারাপ। ফলে এসব দেশে বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমিক কাজ হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছে। আমাদের সবচেয়ে ভয়ের দিক হচ্ছে অদক্ষ শ্রমিক যা মোট অভিবাসীর ৫০ ভাগ, কাজ হারানোর দৌড়ে তারাই সবচেয়ে এগিয়ে থাকবে। আমাদের একটি বিষয় স্মরণ রাখতে হবে, যেহেতু আমরা অভিবাসী কর্মী প্রেরণে ৫ম, তেমনই ক্ষতির পরিমাণও এর আশেপাশে থাকবে। ইতোমধ্যে তার কিছু প্রভাব আমরা দেখতে পাচ্ছি, লকডাউন শুরুর দিকে ২ লাখ ৪০ হাজার শ্রমিক ফেরত আসে, পরে আরও ৫০ হাজার, এর মধ্যে শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকে ফেরত আসে ১ লাখ শ্রমিক। এর সঙ্গে যুক্ত হবে বেআইনিভাবে অবস্থানকারী অভিবাসীরা, এই সংখ্যাটাও কম নয়, যদিও সরকারের কাছে কোনও তথ্য নেই। বিভিন্ন সংস্থার ধারণা অনুযায়ী প্রায় ১০-১২ লাখ অভিবাসী বেআইনিভাবে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। মালয়েশিয়ায় প্রায় ৩ লাখ, ইতালিতে প্রায় ১ লাখ, সৌদি এবং ওমানে অনেক বেআইনি অভিবাসী অবস্থান করছে। বাংলাদেশ থেকে গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ কাজের উদ্দেশ্যে বিদেশ গমন করে, সেই হিসেবে গত ৮ মাসে ৪ লাখ মানুষ বিদেশ যেতে পারেননি। সেই প্রভাবটা আমাদের রেমিট্যান্সে পড়া শুরু করেছে।
১৯৭৬ সালে মাত্র ৩৬ কোটি টাকা দিয়ে শুরু হয়েছিল রেমিট্যান্স যাত্রা, আর গত বছর ২০১৯ সালে রেমিট্যান্স আসে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ১৪ লাখ ৬৭ হাজার কোটি টাকা দেশে পাঠিয়েছে প্রবাসী শ্রমিকরা। ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স আসে মার্চ মাসে মাত্র ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। এপ্রিল-মে মাসে রেমিট্যান্স প্রায় বন্ধ ছিল। এই কারণে জুলাই-আগস্ট মাসে ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসে, যার পরিমাণ ৪ হাজার ৫৬৩ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন ডলার! আর এতেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে সরকার। এবং দাবি করছে রেমিট্যান্সের ওপর কোনও প্রভাব পড়বে না এমনকি রির্জাভেও না। একটু সচেতনভাবে খেয়াল করলে দেখবেন মোট রেমিট্যান্সের একটা বড় অংশ আসতো বেআইনি হুন্ডির মাধ্যমে। সেটা এখন বন্ধ এ কারণে বৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। এরপর যে কারণ রয়েছে তা হলো প্রায় তিন মাস অভিবাসীরা দেশে টাকা পাঠাতে পারেনি, আবার অনেকেই দেশে ফেরত আসতে হবে এজন্য একবারে জমানো সমস্ত টাকা দেশে পাঠিয়েছে। এসব কারণে দুই মাস রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পেয়েছিল। জুলাই মাসের থেকে আগস্ট মাসে রেমিট্যান্স কম আসে ৬৩৫ দশমিক ৬২ মিলিয়ন ডলার। এই প্রবাহ চলতি মাসে আরও কমবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
গত ১২ আগস্ট ২০২০ আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা–আইওএম–রিজিওনাল এভিডেন্স ফর মাইগ্রেশন এনালাইসিস অ্যান্ড পলিসি-রিমেপ প্রকল্পের আওতায় একটি স্টাডি রিপোর্ট করে। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী ৭০ শতাংশ বিদেশ ফেরত অভিবাসী জীবিকা সংকটে রয়েছেন। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ফেরত আসা অভিবাসীরা জীবিকা, আর্থিক সংকট (উপার্জনের অভাব এবং বর্ধিত ঋণ) এবং স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়সহ পুনঃএকত্রীকরণসহ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। বিদেশ ফেরতরা সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় মোট ৫৫ শতাংশ বলেন তাদের ওপর ঋণের বোঝা রয়েছে। এদের মধ্যে ৪৪ শতাংশের ঋণ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে নেওয়া। ঋণের বিপরীতে ১০-১৫ শতাংশ সুদ গুনতে হচ্ছে প্রবাসীদের। আর যারা সুদি মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন, তাদেরকে ৫০-১৫০ শতাংশ সুদ গুনতে হচ্ছে।
কর্ম শেষে যখন একজন প্রবাসী দেশে আসে তখন তার চিরচেনা গ্রাম, পথ-ঘাট, মাঠ, গাছপালা সমস্ত কিছুই তার কাছে নতুন মনে হয়। যে ছেলেটাকে দুই বছর বয়সে রেখে গেছেন অথবা দশ বছরের মেয়েকে, তারা আজ অনেক বড় হয়েছে। যে স্ত্রীকে রেখে গিয়েছিলেন তার মুখমণ্ডলে বয়সের ছাপ পড়েছে, লাবণ্য হারিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে অনেক অভিবাসী অভিযোজিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে হতাশায় ভুগে নানা ধরনের দ্বন্দ্ব-কলহে লিপ্ত হন। এমনকি অনেকের বিবাহ বিচ্ছেদ পর্যন্ত ঘটে। এক্ষেত্রে মনো-সামাজিক পুনর্বাসনের প্রয়োজন হয়, যেটার ব্যবস্থা আমরা করতে পারিনি। প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণ প্রবাসীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও তারা এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে না। আবার পরিবারকে যুক্ত করে আর্থিক ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ না দেওয়ার কারণে তারা কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই সংসার পরিচালনা করেন। ফলে বিদেশ থেকে টাকা আসে খরচ হয়, ঋণের বোঝা রয়েই যায়। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা-আইওএম’র এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রবাসীদের পাঠানো টাকার ৭০ ভাগ ব্যয় হয় খাদ্য আর পোশাকের পেছনে।
একজন অদক্ষ অভিবাসী বিদেশে অবস্থানকালে প্রতিনিয়ত শিখতে থাকেন এবং এক সময় দক্ষ মানুষে পরিণত হন। তখন তার জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যায়, আচার-আচরণ থেকে সমস্ত কিছুতেই এই পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। এমন অবস্থায় দেশে ফেরত এসে পূর্বের জীবনযাত্রায় ফিরে যেতে পারেন না। ফলে নানা ধরনের ‘ফটকা ব্যবসায়’ বিনিয়োগ করে সর্বস্বান্ত হন। এসময় তিনি পুনরায় বিদেশ পাড়ি জমান অথবা মানবেতর জীবনযাপন করেন।
এই সংকট মোকাবিলায় রাষ্ট্রকেই দায়িত্ব নিতে হবে। তার জন্য সরকারের বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। এরমধ্যে ওয়েজ আর্নার্জ বোর্ড, প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক, বিএমইটি, জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিস, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার-টিটিসি, মেরিন একাডেমি এবং যুব উন্নয়ন অধিদফতর প্রমুখ।
লেখক: ফিল্ড অফিসার। প্রোমোটিং পিস অ্যান্ড জাস্টিস–পিপিজে প্রজেক্ট। আরডিআরএস বাংলাদেশ, দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড়।
ইমেইলঃ ssfmithu@gmail.com
Leave a Reply