করোনাকালের আগে স্কুলপড়ুয়া মেয়ের কোচিং শেষে বেইলি রোডে দাঁড়িয়ে আছি, ঠিক এ সময় সাজগোজ করা চার-পাঁচজন মহিলা ছোট ছোট কৌটা হাতে টাকা-পয়সার জন্য আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ওরা চলে যাওয়ার পর মেয়ে বলল- বাবা ওরা কারা, ওদের কৌটার মধ্যে কি ছোট ছোট সাপ আছে? আমি বললাম, ওরা বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ, অনেকদিন ধরেই দেখছি, ওরা এভাবেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত বর্ণনামতে, সারা দেশে বেদে জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৭৫ হাজার ৭০২। দেশের বেশ কয়েকটি জায়গায় এরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসবাস করে। ঢাকার সাভারের নামাবাজারে তাদের একটি বড় অংশের বসবাস আছে। এরা দলবদ্ধভাবে থাকে, একে অপরকে সব ধরনের সহযোগিতা করে। এদের মধ্যে গোত্রের প্রতি শ্রদ্ধা, অঙ্গীকার অপরিসীম। প্রত্যেক গোত্র সরদারের নির্দেশে পরিচালিত হয়।
আমাদের দেশে ৮টি গোত্রে বিভক্ত বেদে সদস্যদের পেশার ওপর ভিত্তি করে গোত্রের নামকরণ হয়ে থাকে। যেমন- মান বেদে, সাপুড়িয়া, বাজিকর, সান্দার, টোলা, মিরশিকারী, বরিয়াল সান্দা ও গাইন বেদে। এদের প্রধান পেশা হচ্ছে ক্ষুদ্র ব্যবসা, তাবিজ-কবজ বিক্রি, সর্পদংশনের চিকিৎসা, সাপধরা, সাপের খেলা দেখানো, সাপ বিক্রি, আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যসেবা, শিংগা লাগানো, ভেষজ ওষুধ বিক্রি, কবিরাজি, বানর খেলা, জাদু দেখানো ইত্যাদি।
বেদে জনগোষ্ঠী জীবিকার প্রয়োজনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়। যখন-যেখানে যায় তখন সেটাই তাদের আবাস। এরা নদীর আশপাশে সমতল ভূমিতে ছাপড়া বানিয়ে, আবার কেউ কেউ নৌকাতেই বসবাস করে। ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা-খরা পুরোটাই পার করে দেয় নৌকার ছৈয়ের নিচে। তাদের আলাদা জীবনবোধ, সংস্কৃতি বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনাচরণ থাকলেও তাদের একটি বড় অংশের সুনির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই। বেদে পরিবারগুলোতে আয়-উপার্জন, কর্তৃত্ব প্রধানত মহিলাদের নিয়ন্ত্রণে। পুরুষ অপেক্ষা মহিলাদের পরিশ্রম করতে হয় বেশি। যতদিন স্ত্রী উপার্জনের জন্য বাইরে থাকে, ততদিন সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব থাকে স্বামীর ওপর। তাদের জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি বললেই চলে। বর্তমানে সমাজের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের আয়-রোজগার কমে গেছে। করোনা মহামারীতে এ সংকট আরও তীব্র হয়েছে।
এ অঞ্চলে বেদে সম্প্রদায়ের আগমনের সময় নিয়ে মতভেদ রয়েছে; কেউ বলেন সতের শতকে আরাকান রাজ বল্লাল রাজের সঙ্গে শরণার্থী হিসেবে বেদেরা এ দেশে আসে। আবার কেউ কেউ বলেন, প্রাচীনকালে মিসর থেকে এসেছে তারা, বেদুইন জনগোষ্ঠীর একটি অংশ, আর এ বেদুইন থেকে তাদের নামকরণ হয়েছে বেদে। যাই হোক, এ অঞ্চলে তাদের বসবাস কয়েকশ’ বছরের।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর দিকে একটু নজর দিলে দেখা যাবে, মূল জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি থাকার পরও এদের জীবনাচরণ অনেকাংশেই ভিন্নরকম। এ চিত্র পৃথিবীর সবখানে। সময় ও চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে মূল জনগোষ্ঠীর জীবনাচরণে যেভাবে পরিবর্তন আসে, এসব জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সেভাবে হয় না। সেজন্য প্রতিনিয়ত মূল জনগোষ্ঠীর সঙ্গে তাদের জীবনযাপন প্রণালিতে পার্থক্য বাড়তেই থাকে।
মানুষের শিক্ষার হার বেড়েছে। সরকার ও বিভিন্ন এনজিওর তরফ থেকে সারা দেশে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বেড়েছে। অবাধ ও সহজলভ্য তথ্যপ্রবাহের সুযোগে কুসংস্কার, অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা থেকে মানুষ বের হয়ে আসছে, অসুখ-বিসুখে ডাক্তারের পরামর্শ নিচ্ছে। এখন সাপের খেলা, বানরের নাচ দেখার জন্য ছেলেমেয়েরা ছুটে যায় না। ঝাড়ফুঁক নিয়ে শরীরের ব্যথা বা বাতের ব্যথা কমানোর আগ্রহও দেখা যায় না। তাই বেদেরা এসব পেশা থেকে সরে আসতে শুরু করেছে।
ফলে তাদের পেশার ক্ষেত্র ও পরিধি নিয়মিত সংকুচিত হয়ে আসছে। এখন আর আগের মতো বহর নিয়ে ঘুরে বেড়ানো বেদে নারী-পুরুষ খুব একটা চোখে পড়ে না। সিনেমা, নাটক, গান, কবিতার পাতার বর্ণিল জীবন তাদের আর নেই। তাদের কোনো উচ্ছ্বাস নেই, প্রাচুর্য নেই, উন্নত জীবনযাপনের কোনো ব্যবস্থা নেই, লেখাপড়া নেই, ছকবাঁধা কাজের মধ্য দিয়ে জীবন পার করে দিচ্ছে। ক্ষুন্নিবৃত্তি নিবারণেই তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই ওরা চলে যাচ্ছে অন্য পেশায়।
এ প্রেক্ষাপটে অনেকেই বলে থাকেন, বেদে বা এ রকম ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী আমাদের লোকজ সংস্কৃতির অংশ ও ঐতিহ্য, এদের সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখতে হবে, একইসঙ্গে তাদের সার্বিক জীবনমান উন্নত করতে হবে। কথা হল, তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষা করে তাদের জীবনমান ‘উন্নয়ন’ কীভাবে সম্ভব? লোকজ বাংলার সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে বলে হা-হুতাশ না করে বাস্তবতার নিরিখে বিষয়টি দেখতে হবে। বেদে সম্প্রদায়ের যে চিত্র আমাদের সামনে ভেসে ওঠে তা হল- তাদের মধ্যে লেখাপড়ার হার কম, তারা পুরনো ও অগ্রহণযোগ্য পেশা ধরে রেখেছে। তাদের মধ্যে অল্পবয়সে বিয়ের প্রবণতা বিদ্যমান। তাদের একটি বিরাট অংশের ডাঙ্গায় থাকার ব্যবস্থা নেই।
বংশপরম্পরায় পানিতে ভাসমান জীবন পার করে দিচ্ছে। রাস্তাঘাটে বেদে মহিলারা কৌটা হাতে নিয়ে মানুষের কাছ থেকে অনেকটা জোর করে ভিক্ষা আদায় করছে, দাঁতের অদৃশ্য পোকা বের করছে, সাপে কাটা রোগীকে সুস্থ করে দেয়ার কসরত করে যাচ্ছে, ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবজ দিয়ে রোগীর চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে লোকজ সংস্কৃতি রক্ষার অংশ হিসেবে তাদের কি ওইসব পেশা ও জীবনযাপন প্রণালিতে সীমাবদ্ধ রাখা সমীচীন হবে? বর্তমান যুগে তাদের ওইসব পেশা কি টিকিয়ে রাখা যাবে? সংস্কৃতি রক্ষার অজুহাতে তাদের এ ধরনের পেশাকে কখনই সমর্থন করা যাবে না।
সুস্থ, পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনে মানুষ যা কিছু আয়ত্ত করে, অনুসরণ করে, পালন করে- সবকিছুই সংস্কৃতির অংশ। মানুষের জীবনযাপন প্রণালি তার সংস্কৃতির প্রকাশ। আসলে সংস্কৃতি স্থির ও নিশ্চল কোনো বিষয় নয়। মানুষ টিকে থাকতে ও নিজেকে বিকশিত করার জন্য পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে সাজিয়ে তুলবে, এটাই স্বাভাবিক। সময়ের তাগিদে তাই সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসবে, নিজেকে সেভাবে প্রস্তুত করতে হবে। আর এ প্রেক্ষাপটে সরকার বেদে ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটের তথ্যমতে, স্কুলগামী বেদে ও অনগ্রসর শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে তোলার লক্ষ্যে চার স্তরে জনপ্রতি ৭শ’ থেকে ১২শ’ টাকা পর্যন্ত প্রতি মাসে বৃত্তি দেয়া হচ্ছে। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্তকরণের মাধ্যমে সমাজের মূল স্রোতধারায় নিয়ে আসার জন্য কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। প্রশিক্ষণোত্তর পুনর্বাসন সহায়তা হিসেবে ১০ হাজার টাকা অনুদান দেয়া হচ্ছে। ৫০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল ব্যক্তিকে জনপ্রতি ৫০০ টাকা বিশেষ ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
আমাদের চিন্তাভাবনা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, পেশাসহ সার্বিক জীবনযাপন প্রণালিতে পরিবর্তন এসেছে এবং নিয়মিত আসছে। যেমন, বর্তমানে টেলিগ্রাম, টেলিগ্রাফের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। ব্যক্তিগত চিঠি (হার্ডকপি) আদান-প্রদান উপযোগিতা হারিয়েছে। ছবি প্রিন্ট করার কালার ল্যাবগুলো প্রধানত পাসপোর্ট সাইজের ছবি তোলা ও প্রিন্ট করার মধ্যে বৃত্তাবদ্ধ হয়ে গেছে। এখন মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ক্যামেরা, টর্চলাইট, ক্যালকুলেটর, রেডিও-টিভির কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। এসব জিনিসপত্রের উৎপাদক, পরিবেশক, বিক্রেতারা নতুন করে আপন ঠিকানা বেছে নিয়েছে।
অনলাইন আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্র ও পরিধি যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে, আর ক’দিন পর পকেটে টাকা বহনের সংস্কৃতিও হারিয়ে যাবে। এভাবে অনেক কিছুই পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিস্থিতির বিবেচনায় অনেক কিছু ত্যাগ করতে হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরনো ধ্যানধারণা, মূল্যবোধ এমনিতেই আবেদন হারিয়ে থাকে, ফলে জীবনযাপন পদ্ধতিও পরিবর্তন হয়ে যায়। তাই অনেক ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী নিজেদের স্থবির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে মূল জনস্রোতের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। পৃথিবীতে এ ধরনের অনেক উদাহরণ আছে।
তাই সার্বিক বিষয়গুলো অনুধাবন ও বিশ্লেষণ করে বেদে এবং ওই ধরনের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোকে আলোকিত জীবনের পথ দেখাতে হবে, তাদের লেখাপড়ায় উৎসাহিত ও বাল্যবিয়ে রোধ করতে হবে। যে পেশাগুলোর পরিবর্তিত সামাজিক প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতার নিরিখে গ্রহণযোগ্যতা নেই, সেগুলো থেকে তাদের বের করে আনতে হবে।
এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে গৃহীত পদক্ষেপের পাশাপাশি তাদের কর্মে নিয়োগে শিল্পমালিক, ব্যবসায়ী ও সচ্ছল ব্যক্তিদের উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের জন্য সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। ভাসমান ও যাযাবর জীবন থেকে সরিয়ে এনে বাসস্থান, উন্নততর কর্মসংস্থান এবং সবার সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের মূলধারায় অঙ্গীভূত করে নিতে হবে তাদের।
সালাহ্উদ্দিন নাগরী : সরকারি চাকরিজীবী। snagari2012@gmail.com
Leave a Reply