সড়ক যোগাযোগে অভাবনীয় উন্নয়নের পাশাপাশি চট্টগ্রামকে পর্যটন নগরীর পথে বিশাল একটি ধাপ এগিয়ে নিচ্ছে আড়াই হাজার কোটি টাকার সিটি আউটার রিং রোড। সাগর তীরঘেঁষা এ সড়কের কাজ এখন একেবারেই শেষ পর্যায়ে। এরইমধ্যে শুরু হয়ে গেছে যানবাহন চলাচল। চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসের আগে শেষ হয়ে যাবে মূল রিং রোডের কাজ। এরপর ছোট তিনটি সংযোগ সড়ক নির্মিত হয়ে গেলেই বন্দরনগরী উদ্ভাসিত হবে নতুন চেহারায়।
চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড একটি স্বপ্নের প্রকল্প। যানজট নিরসনে যেমন এ সড়কটি ভূমিকা রাখবে, তেমনিভাবে রিং রোড নির্মিত হয়ে গেলে চট্টগ্রাম এক নান্দনিক শহরে পরিণত হবে। ফৌজদারহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত যাওয়া যাবে সাগরের পাড় দিয়ে। এতে সময় কম লাগবে, উপভোগ করা যাবে সাগরের ঢেউ ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। রিং রোডের কাজ পুরোপুরি শেষ না হলেও যেটুকু হয়েছে তাতেই চলাচল করছে যানবাহন। করোনার কারণে মাঝে স্থবিরতা দেখা গেলেও এখন পুরোদমে এগিয়ে চলেছে কাজ। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০২১ সাল পর্যন্ত হলেও এ ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই রিং রোডের মূল কাজ শেষ হবে বলে জানিয়েছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক)।
প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চউক জানায়, পতেঙ্গায় সাগর তীরে আউটার রিং রোডের কাজ এখন শেষের দিকে। কার্পেটিং হয়ে যাওয়ায় যানবাহন চলাচলে সমস্যা হচ্ছে না। এখন চলছে সড়কের ধারে ব্লক বসানো এবং সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ। যানবাহনগুলো ফৌজদারহাট হয়ে রিং রোড ধরে পতেঙ্গা পর্যন্ত যেতে পারছে অল্প সময়ের মধ্যে। এতে করে শহরের ভেতরের সড়কের ওপর চাপ কিছুটা হলেও কমেছে। তিনটি ফিডার রোড বা সংযোগ সড়কের কাজ হয়ে গেলে মিলবে শতভাগ সুফল। তখন চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ পোর্ট কানেক্টিং রোডসহ প্রধান সড়কে পরিবহনের দুর্ভোগ অনেক কমে যাবে।
চউক প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন সামস জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নের অগ্রগতি ৯২ শতাংশ। মূল সড়কে কার্পেটিং সম্পন্ন হওয়ায় যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। প্রাকৃতিকসহ কিছু অন্তরায় থাকায় এবং পরিকল্পনায় পরিবর্তন আসায় প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০২১ সাল পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর আগেই কাজ শেষ করা সম্ভব হবে বলে জানান চউকের এই কর্মকর্তা।
প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সিটি আউটার রিং রোডের সঙ্গে সংযোগের জন্য নির্মিত হবে তিনটি ফিডার রোড। এ সড়ক দিয়ে নগরী থেকে যানবাহনগুলো রিং রোডে যাওয়া আসা করতে পারবে। এরমধ্যে ফিডার রোড-১ হল পতেঙ্গা স্টিল মিল এলাকার নারিকেলতলা দিয়ে বেড়িবাঁধ পর্যন্ত। ফিডার রোড-২ মিলিত হবে বড়পুল থেকে আনন্দবাজার হয়ে বেড়িবাঁধে। আর ফিডার রোড-৩ বেড়িবাঁধ পর্যন্ত যাবে সাগরিকা হয়ে। তিন নম্বর ফিডার রোডে থাকছে ফ্লাইওভার। এ তিনটি সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রগতি কম। তবে কিছু প্রতিবন্ধকতা থাকলেও এখন তা আর নেই।
চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোডের দৈর্ঘ্য ১৭ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার। এরমধ্যে মূল আউটার রিং রোডের দৈর্ঘ্য ১৫ দশমিক ২০ কিলোমিটার। বাকি ২ দশমিক ১৫ কিলোমিটার হচ্ছে সংযোগ সড়ক বা ফিডার রোড। কিছু কাজ বাকি থাকলেও মূল সড়কের পিস ঢালাইয়ের কাজ অনেকটা শেষ। এখন চলছে ওয়ার্কওয়ে নির্মাণ, ব্লক তৈরি এবং ব্রিজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু কাজ। বেড়িবাঁধের ওপর নির্মিত এ সড়কের উচ্চতা ৩০ ফুট, যা চট্টগ্রাম বন্দর, বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও স্থাপনাসহ পুরো শহরকে রক্ষার কাজও করবে।
চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোড প্রবেশ করবে কর্ণফুলীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেলে, যা চলে যাবে আনোয়ারা হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত। ওদিকে, মীরসরাই থেকে সীতাকুন্ড হয়ে মেরিন ড্রাইভ ফৌজদারহাট এলাকায় মিলিত হবে আউটার রিং রোডের সঙ্গে। এছাড়া এরই মধ্যে ফৌজদারহাট এসে মিলেছে বায়েজিদ লিংক রোড। যানবাহন চলাচল শুরু হয়ে যাওয়ায় ব্যক্তিগত গাড়িতে এখন চট্টগ্রাম মহানগরীর লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা সি বিচ ও বিমানবন্দর পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে আধাঘণ্টার মধ্যে। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে লালখান বাজার থেকে শুরু হওয়া আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভার। সবমিলে চট্টগ্রাম ঘিরে যে অপার সম্ভাবনার হাতছানি, সে পর্যন্ত পৌঁছাতে আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদগণ।
প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম সিটি আউটার রিং রোডের পরিকল্পনা অনেক আগের। ২০০৫ সালে এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করে জাপানের সাহায্য সংস্থা জাইকা। ২০০৭ সালে এ ব্যাপারে জাইকার সঙ্গে চুক্তি হয়। শুরুতে ব্যয় ধরা হয় ৮৬৫ কোটি ২৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা। পরিকল্পনায় পরিবর্তন কয়েকদফা সংশোধনীর ফলে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়ায় ২ হাজার ৪২৬ কোটি ১৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকায়। এরমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের ব্যয় ১ হাজার ৭২০ কোটি ১১ লাখ ৯৫ হাজার টাকা, আর জাইকা দিচ্ছে ৭০৬ কোটি টাকা। তবে নতুন সংযোগ সড়কেও কিছু পরিবর্তন আসায় এর ব্যয় আরও বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আভাস রয়েছে।
Leave a Reply