করোনা মহামারির মধ্য দিয়েই ২০২০ সালটি দ্রুত শেষ হচ্ছে। এই মহামারি বিশ্বব্যাপী সব ব্যবসাবাণিজ্যে কম-বেশি ধস নামিয়েছে। লাখ লাখ মানুষকে করেছে কর্মহীন। বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসাবাণিজ্যও বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশ সাময়িক লকডাউনে ছিল। তখন মানুষ একরকম গৃহবন্দি হয়ে পড়ে, গোটাদুনিয়া যেন হয়ে যায় স্থবির। এই পরিস্থিতিতে দেশের অধিকাংশ অফিস-আদালত, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। বিদেশিদের চলাচল কমে যায়, অধিকাংশ এম্ব্যাসি বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সেখানে কর্মরত বিদেশিদের সিংহভাগ স্বদেশে ফিরে যান। বিদেশিদের জন্য চলতি বছরের হজ বাতিল হয়, ওমরা হজ বন্ধ থাকে দীর্ঘদিন। সরকারি-বেসরকারি-রাষ্ট্রীয় প্রায় সব বৈদেশিক সফর স্থগিত করা হয়। প্রবাসীদের দেশে আসা-যাওয়া থেমে যায়। জনশক্তি রপ্তানিতে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়। পর্যটনশিল্প হয়ে পড়ে স্থবির । ইউনাইটেড নেশনস ওয়ার্ল্ড টুরিজম অরগানাইজেশনের (UNWTO) মতে, এ বছর বাংলাদেশ পর্যটনশিল্প প্রায় ৪০ বিলিয়ন টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ইন্টারন্যশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশনের (IATA) তথ্যমতে, এভিয়েশন সেক্টরে এ বছর বাংলাদেশের রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে প্রায় ২৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (TOAB) মতে, এ খাতে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয় ৫৭ বিলিয়ন টাকা। সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি মাসে এভিয়েশন সেক্টরে ক্ষতির পরিমাণ ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
করোনা মহামারির কারণে পর্যটনশিল্প, এয়ারলাইনস, ট্যুর ও ট্রাভেল ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্যুর গাইড, ক্রুজ, ভ্যাসেলস এবং অন্যান্য যানবাহন ইত্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় ৪০ লাখ কর্মী বাহিনীর অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়েছেন, অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, কোথাও কোথাও কর্মী ছাঁটাই কিংবা বেতন হ্রাস করা হয়েছে। TOAB-এর মতে, ২০-৩০ শতাংশ কর্মীর চাকরি হারানোর আশঙ্কা রয়েছে। পর্যটনশিল্প সংশ্লিষ্ট খাতে দেশের যে সংখ্যক মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়েছে, তা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ৩.৭ শতাংশ। তবে বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতির এখনো খুব একটা উন্নতি না হলেও, মানুষের জীবনজীবিকা নির্বাহের জন্য লকডাউন থেকে বেরিয়ে কাজে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশে জুন মাস থেকে লকডাউন শিথিল হলে অফিস-আদালত, ব্যবসাবাণিজ্য পর্যায়ক্রমে খুলে যায়, কর্মচাঞ্চল্য অনেকটাই ফিরে আসে। অভ্যন্তরীণ ও সীমিতসংখ্যক আন্তর্জাতিক ফ্লাইট আবার চালু হয়েছে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি থেকে দেশের অধিকাংশ দর্শনীয় স্থান পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে।
কোভিড-১৯-এর আগে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন রুটের ২৫টির বেশি এয়ারলাইন্স কোম্পানি ফ্লাইট পরিচালনা করত। দীর্ঘদিন এয়ারলাইন্স চলাচল বন্ধ থাকার পর বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে বিমানসহ ১৩টির মতো এয়ারলাইন্স আন্তর্জাতিক রুটে সীমিত সংখ্যক ফ্লাইট পরিচালনা করছে। তবে সবার মধ্যে করোনা আক্রান্ত হওয়ার ভয় থাকায় যাত্রী চলাচল স্বভাবিক হয়নি। জাতিসংঘের মতে, ২০২০ সালের প্রথমার্ধেই বিশ্বে পর্যটন শিল্পে প্রায় ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি হয়েছে, যা বছর শেষে ১ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। তাছাড়া এ খাতে কর্মরত প্রায় ১০০ মিলিয়ন মানুষ রয়েছে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারির কারণে এভিয়েশন খাতে প্রতিদিন ১.২ বিলিয়ন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে এবং পর্যটন শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত হোটেল, রেস্টুরেন্ট, এয়ারলাইনস, ক্রুজ, জাহাজ, ট্যুর অপারেটর, যানবাহন ও ট্যুরগাইড সবার সম্মিলিত ক্ষতি দৈনিক ৩ বিলিয়ন ডলার। তাই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতারেস টেকসই উপায়ে পর্যটনশিল্পকে উদ্ধারের জন্য আহ্বান জানিয়েছেন।
এই মুহূর্তে পর্যটন খাত এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপ-খাতগুলোকে সচল করতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যেমন: অভ্যন্তরীণ পর্যটনকে উত্সাহিত করা, ট্যাক্স অব্যাহতি বা কমানো, তহবিল গঠন করা, নতুনভাবে বিনিয়োগ করা, আনুষঙ্গিক খরচ কমানো, সামাজিক ও ব্যক্তির নিরাপত্তা ব্যবস্থা, আনুষঙ্গিক কর অব্যাহতি বা কমানো, ট্রাভেল এজেন্সিদের ক্যাশ-ফ্লো সহায়তা, ঋণের ওপর সুদের হার কমানো এবং নতুন ঋণ প্রদান, দেনা স্থগিত রাখা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা, এয়ারলাইনসগুলোর জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা, কর্মচারীদের আংশিক বেতন সরকার কর্তৃক প্রদান, সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ, সংকট মোকাবিলায় কৌশল প্রণয়ন এবং দেশীয় পর্যটনের প্রসারে প্রচার ও বিপণন ইত্যাদি। এছাড়া পর্যটনশিল্পের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এখন প্রয়োজন—পর্যটকদের আকৃষ্ট করা, তাদের মধ্যে বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ গ্রহণ এবং বিনিয়োগের ব্যবস্থা করা। বাংলাদেশ সরকার এরই মধ্যে এই ধরনের অনেক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের কথা এখন জোরেশোরে শুনা যাচ্ছে। বিশেষ করে শীতের সময় এর প্রকোপ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। তাই বিশ্বব্যাপী করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও এর সর্বজনীন ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত বিশ্ববাসীর মনে শঙ্কা কাটবে না এবং জাতীয় তথা বিশ্ব অর্থনীতি সহসা আগের অবস্থায় ফিরবে না।
লেখক : উপমহাপরিচালক, সেনাকল্যাণ সংস্থা, (সেনাকল্যাণ ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরস)
Leave a Reply