প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিআরটি বাস্তবায়িত হলে এই রুটে প্রতি ঘণ্টায় ২৫ হাজার যাত্রী দ্রুত তাদের গন্তব্যে যেতে পারবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজট অনেকটাই কমে যাবে। যাতায়াতের সময় কমে যাওয়ার কারণে বাসের ট্রিপসংখ্যা বেড়ে যাবে। ফলে পরিবহন মালিকদের আয় বাড়বে। যাত্রীরা দ্রুততম সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছার ফলে কর্মদক্ষতা বেড়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সাড়ে ২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ঢাকা-গাজীপুর বির্দমান সড়কের মাঝ বরাবর নির্মিত হচ্ছে বাস র্যাপিড ট্রানজিটের রুট। প্রকল্পে থাকছে, চার দশমিক ৫ কিলোমিটার এলিভেটেড ফ্লাইওভার ও সেতু। যার মধ্যে ৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার ৬ লেন বিশিষ্ট এবং ১ কিলোমিটার ২ লেন বিশিষ্ট। থাকছে ৬টি এলিভেটেড স্টেশন ও ১০ লেন বিশিষ্ট টঙ্গী সেতু। ছয়টি উড়াল সড়ক ও আন্ডারপাস। জলজট নিরসনে প্রকল্পের আওতায় টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। ধীরগতির যানবাহন চলাচল করবে পৃৃথক লেনে। দ্রুতগতির যান চলাচলের জন্য সড়কের মাঝ বরাবর দুই লেন পৃথক করা হবে। ২০১২ সালে বিআরটি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে নানা জটিলতায় প্রকল্পের কাজ বিলম্বিত হয়। ্শুরুতে প্রকল্পটি ২ হাজার ৪০ কোটি টাকার প্রাক্কলন করা হলেও ২০১৮ সালের ৪ নবেম্বর দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা করা হয়।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, সাড়ে ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই বিআরটি প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি এখন ৪২ ভাগ। করোনাকালে প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকলেও গত এক মাস ধরে কাজ চলছে। সম্প্রতি কাজে আরও গতি এসেছে। এদিকে টঙ্গী-জয়দেবপুর সড়কে জনদুর্ভোগ কমাতে প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, কোর কারণেই কাজ থেমে থাকবে না। এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। প্রকল্পের এখন অর্থ সঙ্কট কেটে গেছে। তাই বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোন রকম জটিলতা নেই।
সরকারের তিন প্রতিষ্ঠান প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তবে বিভিন্ন কারণেই সবার অগ্রগতি এক রকম নয়। বিআরটি, গাজীপুর-বিমানবন্দরের সেতু কর্তৃপক্ষ অংশের প্রকল্প পরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, ‘বিআরটি প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে এলজিইডি, সেতু কর্তৃপক্ষ এবং সওজ মিলে। তাই সার্বিকভাবে বলতে না পারলেও সেতু কর্তৃপক্ষ অংশের অগ্রগতি ৩২ শতাংশ। তিনি বলেন, করোনা সংক্রমন, বন্যা, বর্ষার কারণেও কাজ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন কাজের গতি ফিরেছে। আশা করছি, সব সমস্যা কেটে যাবে। সেতু কর্তৃপক্ষের অংশের কাজ পিছিয়ে পড়ার ক্ষেত্রে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ‘স্মেক’ লিখিতভাবে জানিয়েছে, ভূগর্ভস্থ এবং মাটির ওপরে অবস্থিত বিভিন্ন ধরনের ইউটিলিটি লাইন থাকায় অনেক স্থানেই পাইল ক্যাপ রি-ডিজাইন করতে হচ্ছে। হাউজ বিল্ডিং থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত আর কোন পাইল অবশিষ্ট না থাকায় টঙ্গী ব্রিজ থেকে চেরাগ আলী পর্যন্ত অবশিষ্ট ১৬০টির মতো পাইল নির্মাণ করতে হবে। এ দূরত্ব পর্যন্ত ভূগর্ভস্থ ইউটিলিটি থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, যানজটের কারণে মহাখালী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত যেতে যত সময় লাগে এর চেয়ে অনেক কম সময়ে ময়মনসিংহ পৌঁছানো যায়। এই রুটে বছরের পর বছর যাত্রীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত ফোর লেন প্রকল্প চালু হলেও ঢাকা-গাজীপুরের দুর্ভোগের কারণে এর সুবিধা যাত্রী ও পরিবহন মালিক শ্রমিকরা পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, বিআরটি প্রকল্পের কাজ শেষ হলে আশা করি জনদুর্ভোগ কমবে। সেইসঙ্গে যাত্রীদের চলাচলের পথ আরও সুগম হবে। তিনি দ্রুত প্রকল্পের কাজ শেষ করার তাগিদ দেন।
গত সপ্তাহে বিআরটি প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা সভায় অংশ নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেন, কাজ থেমে নেই। সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৪২ ভাগ। প্রকল্প এগিয়ে নিতে এখন আর কোন জটিলতা নেই। আশা করছি, দ্রুত কাজ শেষ হবে। কাজের গতি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, সরকার একে একে সবগুলো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ শেষ করতে চায়। সঙ্কট যতই আসুক উন্নয়ন থেমে থাকবে না। যে কোন মূল্যে আমরা সম্ভাবনার সবগুলো প্রকল্পের কাজ শেষ করব। প্রকল্পের ১ নম্বর প্যাকেজের আওতায় ১৬ কিলোমিটার বিআরটি লেন ও ১৯টি স্টেশনসহ আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণের কাজ করছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চীনা গেঝুবা গ্রুপ কর্পোরেশন (সিজিজিসি)। গত জুন পর্যন্ত প্যাকেজটির নির্মাণ কাজ এগিয়েছে ৪২ দশমিক ৫২ শতাংশ। বৈঠকে এ প্রকল্পের কাজ দ্রুত এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়। ওবায়দুল কাদের সংশ্লিষ্টদের কাজ এগিয়ে নেয়ার নির্দেশনা দেন।
এদিকে নগরবিদরা বলছেন, যানজট নিরসন করতে হলে এ ধরনের একটি প্রকল্পই যথেষ্ট নয়। প্রকল্পটি ঢাকার আশপাশের জেলা-উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারণের পরামর্শ নগর বিশেষজ্ঞদের। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ড. নুরুল ইসলাম নাজেম বলেন, গাজীপুর থেকে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে রাজধানীর যানজট সমস্যার সমাধান হবে না। এটা সত্য এবং বাস্তব। তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, যানজট নিরসনে বিআরটি প্রকল্পটি আরও সম্প্রসারণ করতে হবে। গাজীপুর থেকে নারায়ণগঞ্জ, সাভার, বুড়িগঙ্গা পেরিয়ে মাওয়া ঘাট পর্যন্ত এই রুট সম্প্রসারণ করা গেলে সুফল মিলবে। সম্ভব হলে এই প্রকল্পটি ময়মনসিংহ-নরসিংদীসহ আশপাশের জেলাসমূহ পর্যন্ত নেয়া যেতে পারে।
তিনি বলেন, বর্তমান নক্সা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সাময়িক কিছু সুবিধা বাড়বে। সীমিত আকারে হলেও সর্বোপরি কিছু র্যাপিড ট্রানজিটের ব্যবস্থা হবে। ঢাকা পূর্ব-পশ্চিম এলাকায় রাস্তা না বাড়ালে যানজট সমস্যার সমাধান হবে না। তিনি বলেন, ব্যবস্থাপনার অভাবে ঢাকার চার ভাগের মধ্যে এক ভাগের বেশি রাস্তা ব্যবহার করা যায় না। কিন্তু নিউইয়র্কে ছোট রাস্তা হলেও ওয়ানওয়ে করা আছে। সেখানে ব্যবস্থাপনা ভাল থাকায় চলাচলে সমস্যা নেই। আমাদের দেশের রাস্তা দখলমুক্ত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে কোন সমস্যা হবে না বলেও মনে করেন তিনি। তবে যথাসময়ে কাজ শেষ করার বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ এই বিশেষজ্ঞের।
Leave a Reply