সারা দেশের নৌপথজুড়ে সংঘটিত হচ্ছে নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ড। ডাকাতি, চাঁদাবাজি, অবৈধ কারেন্ট জালের ব্যবহার, মাদক বহনের রুট, অবৈধ বালু উত্তোলনসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে অনেকে। মাঝেমধ্যেই উদ্ধার হচ্ছে ভাসমান লাশ। আর এসব অপরাধীর ছত্রছায়ায় রয়েছে কিছু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি। তাদের হস্তক্ষেপে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাহত হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম। করোনাকালীনও অপরাধীরা তৎপর থাকায় তাদের লাগাম টানতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে নৌপুলিশ। তবে মাঠপর্যায়ে কর্মরত নৌপুলিশের সদস্যরা দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে গিয়ে নানা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন। হুমকি ও হামলার শিকারও হচ্ছেন অনেকে। সব বাধা উপেক্ষা করে নৌপথের আইন লঙ্ঘন ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে নৌপুলিশের অভিযানে গত ৯ মাসে ২ হাজার ২৯১ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। আর বিভিন্ন অপরাধে ৭৪৪টি মামলা হয়েছে। উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ নিষিদ্ধ জাল, মাদকদ্রব্যসহ অপরাধমূলক কর্মকান্ডে ব্যবহৃত বিভিন্ন নৌকা, ট্রলার, বাল্কহেড, ড্রেজার, ফিশিংবোর্ড। অপরাধীদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ১ হাজার ৩১৮ জন।
নৌপুলিশের কর্মকর্তারা বলেছেন, নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের উৎপাদন ও ব্যবহারসংক্রান্ত অপরাধ সংঘটনের নেপথ্যে রয়েছে স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালী। তাদের অনেকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে, তারপরও থেমে নেই তাদের কর্মকান্ড। গত ৯ মাসে নৌপুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়াদের বেশিরভাগই মৎস্য আইন লঙ্ঘন, মাদকের চোরাচালান, চাঁদাবাজি ও বেপরোয়া নৌযান চালানোর অপরাধে। দিন দিন এসব অপরাধের মাত্রা বেড়েই চলেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের প্রতিহত করতে তৎপর রয়েছে নৌপুলিশ।
নৌপুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নৌপুলিশের অভিযানে ২ হাজার ৪৫৮ কোটি ৫৩ লাখ ৬ হাজার ৯৮০ টাকা মূল্যের নিষিদ্ধ জাল জব্দ করে ধ্বংস, ২ কোটি ৩৪ লাখ ৯৯ হাজার টাকা মূল্যের জাটকা ইলিশ জব্দ, ১৯৩টি লাশ উদ্ধার, বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনায় ৭৪৪টি মামলা ও এসব মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছে ২ হাজার ২৯১ জন। নৌপথে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৩৪০ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১ হাজার ৫৩৬ জনকে। এছাড়া মৎস আইন লঙ্ঘন করায় ১৮৮ মামলায় ৩২৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেপরোয়া নৌযান চলাচলের কারণে ৭০ মামলায় ১৩০, মাদক বহনের দায়ে ৩০ মামলায় ৪২, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন ও মাটি ব্যবস্থাপনার ১৭ মামলায় ৭৩ এবং ১১টি চাঁদাবাজির মামলায় ৩৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে নয়টি।
নৌপুলিশের ডিআইজি মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘নৌপথের অপরাধের মধ্যে অবৈধভাবে মাছ ধরার বিষয়, নৌপথের ডিসিপ্লিন, অবৈধ বালু উত্তোলন ও নদীদূষণ এ চারটি বিষয় নিয়ে নৌপুলিশ কাজ করে। এসব ক্ষেত্রে আমরা সফলতা পাচ্ছি। এক বছরে ৯৭ কোটি মিটার কারেন্ট জাল আমরা উদ্ধার করেছি। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিচ্ছি। নদীদূষণ বন্ধেও আমরা কাজ করছি। নৌ চলাচলে ডিসিপ্লিন আনতে কাজ করে যাচ্ছি। যেসব বিষয়ে কাক্সিক্ষত ফল এখনো আসেনি সেগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে আরও কঠোর অবস্থান হবে।’
মাঠপর্যায়ে কর্মরত নৌপুলিশ সদস্যদের ঝুঁকির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘এটা চাকরির একটি পার্ট। ঝুঁকিও নিতে হবে আবার ঝুঁকি কীভাবে মোকাবিলা করবে সেই প্রশিক্ষণও তাকে নিতে হয়। মানুষ হুমকি দেবে, সেই হুমকিটাকে কীভাবে কুলডাউন (শান্ত) করা যাবে সেটাও তার জানা আছে। কেউ নিজ থেকে অন্যায় না করলে সাধারণত হুমকি দিয়ে শেষ পর্যন্ত কিছু করতে পারে না। তাছাড়া সেগুলো দেখার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আছে।’
নৌপথের বিভিন্ন অপরাধের বিষয়ে জানতে চাইলে মাঠপর্যায়ে দায়িত্ব পালনকারী নৌপুলিশের সদস্যরা বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। মুন্সীগঞ্জের চর আবদুল্লাহপুর ফাঁড়ির ইনচার্জ মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘গত তিন মাসে মেঘনা নদী থেকে ২৮ ডাকাত ও চাঁদাবাজ গ্রেপ্তার করেছি। নদীতে কাজ করার ক্ষেত্রে অনেক ঝুঁকি থাকে। তার ওপর আবার আমাদের কাজের ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালীরা নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। বিশেষ করে নিষিদ্ধ সময়ে মাছ ধরতে বাধা দিলে বদলির হুমকিসহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন।’
মুক্তারপুরে ধলেশ্বরী নদীতে দায়িত্বে থাকা নৌপুলিশের ইন্সপেক্টর মো. কবির হোসেন বলেন, ‘এই এলাকায় নিষিদ্ধ কারেন্ট জালের উৎপাদন ও ব্যবহারসংক্রান্ত অপরাধ বেশি সংঘটিত হয়। স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি এর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকে। এদের মধ্যে অন্যতম গোলাম মোস্তফা চেয়ারম্যান। তার নামে দুটি ও তার ভাইয়ের নামে ১০টি মামলা রয়েছে। তাদের ছত্রছায়ায় নদীতে কারেন্ট জালের ব্যবহার হয়।’
মাওয়া ঘাটের দায়িত্বে থাকা নৌপুলিশের ইন্সপেক্টর এএম সিরাজুল কবির বলেন, ‘এই এলাকায় অবৈধ জালের বিক্রয় ও ব্যবহার রয়েছে। বিশেষ করে মুক্তারপুর থেকে এসব জাল কিনে দক্ষিণবঙ্গে নিয়ে যায় জেলেরা। আমরা অভিযান চালিয়ে প্রায়ই তাদের আটক করি।’ তিনি আরও বলেন, ‘চলতি বছর আমরা পাঁচটি লাশ পেয়েছি। এলাকার অপরাধ দমনে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
Leave a Reply