দেশ বিভাগের পর কলকাতা বন্দর ব্যবহারের সুযোগ না থাকায় সর্বেোচ্চ আগ্রাধিকার দিয়ে দর্শনা-যশোর রেলপথ নির্মাণ এবং মোংলা বন্দর স্থাপনের প্রকল্প গ্রহন করা হয়। এ দুটি প্রকল্প ১৯৫১ সালে বাস্তবায়িত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হওয়ায় ঢাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিনত হয়। পরে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী ও আমদানি -রপ্তানির সুবিধার্থে চট্টগ্রামের সঙ্গে ঢাকার রেলপথের দুরত্ব কমিয়ে আনার বিষয়টি বিবেচনায় আসে। সে অনুযায়ী ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে সমীক্ষা করার জন্য রেলওয়ের প্রকৌশলী সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ায় প্রস্তাবটি আলোর মুখ দেখেনি। স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত পার্বতীপুরে কেন্দ্রীয় লোকোমোটিভ মেরামত কারখানা এবং যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মানের ফলে সিরাজগঞ্জের জামতৈল থেকে ঢাকা পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেল লাইন স্থাপন ব্যতিত রেলওয়ের আর কোন উন্নয়ন হয়নি। তবে বিভিন্ন সময় ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে কর্ডলাইন নির্মানের বিষয়টি আলোচিত হলেও ২০০৬ সাল পর্য ন্ত এ নিয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এরপর তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে লাকসাম-ঢাকা কর্ডলাইন নির্মানের জন্য মেসার্স এমএমসি ইন্টারন্যাশনালকে ফিজিবিলিটি স্টাডি এবং ডিজাইন তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। তদানুযায়ী এমএমসি কর্তৃক ২০০৯ সালে পরীক্ষা নীরিক্ষা করে সম্ভাব্য অ্যালাইনমেন্ট হিসাবে তিনটি অপশন বাছাই করা হয়। এরমধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের সঙ্গে বিশদ আলোচনার পর লাকসাম থেকে ফতুল্লা (অপশন-২) পর্যন্ত কর্ডলাইন নির্মানের অপশনটি সর্বোত্তম হিসাবে বিবেচিত হয়। এই অপশন সমীক্ষা করার সময় ন্যুনতম দুরত্ব, গ্রাম ও শহরের কম জনবহুল এলাকা, ধর্মীয় উপাসনালয় ও কবরস্থান যেন না পড়ে ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করা হয়। এ ছাড়া রেল পরিচালনায় সুবিধা, যাত্রীসাধারণের যথাযথ স্টেশন ব্যবহারের উপযুক্ততা, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণে উপযুক্ত জায়গা নির্বাচন ও পরিবেশগত দিক বিবেচনা করা হয়।
আমার মতে, ঢাকা-চট্টগ্রাম কর্ডলাইনটি ডুয়েল গেজের হওয়া সমীচীন। সেক্ষেত্রে এর আগে বিবেচিত ২০০৯ সালের এসএমইসি কর্তৃক সমীক্ষাকৃত দ্বিতীয় অপশনটি বিবেচনা করা যেতে পারে। এই অ্যালাইনমেন্টটি কুমিল্লার ৬৭, মুন্সীগঞ্জের ১৩টি এবং নারায়ণগঞ্জের ২৫টি গ্রামের ওপর দিয়ে যাবে; যেগুলোর বেশির ভাগ কৃষিজমি এবং কম ঘন বসতিপূর্ণ এলাকা। অ্যালাইনমেন্টটি ৫৯টি খালবিল, নদীনালার ওপর দিয়ে যাবে। তিনটি সবচেয়ে বড় নদী মেঘনা, গোমতী ও শীতলক্ষ্যা অতিক্রম করতে হবে। অ্যালাইনমেন্টটিতে ১০৩টি রোড ক্রসিং রয়েছে বিভিন্ন ক্যাটাগরির, আটটি জায়গায় বিদ্যুতের লাইন এবং ঢাকা-লাকসামের মধ্যবর্তী একটি জায়গায় গ্যাসের পাইপলাইন পড়বে; যেগুলো স্থানান্তর করতে হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এই কর্ডলাইনে নয়টি ব্লক স্টেশন প্রস্তাব করা হয়েছে।
অপশনটি মাটির ওপর দিয়ে রেললাইন নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। বর্তমানে এলিভেটেড উড়াল রেলপথ নির্মাণের বিবেচনা করা হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সমীক্ষায় উল্লিখিত জমি অপেক্ষা অনেক কম জমি অধিগ্রহণের প্রয়োজন হবে। তাই সময় ও অর্থ সাশ্রয়ের জন্য ফতুল্লা অপশনের প্রাক্কলনটি প্রয়োজন অনুযায়ী সংশোধন করে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে ডিজাইন ও বিল্ট পদ্ধতিতে নির্মাণের জন্য প্রকল্পটি অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এ সময়ের মধ্যে যদি লাকসাম-চট্টগ্রাম মিটার গেজ লাইনকে ডুয়েল গেজে রূপান্তরের প্রকল্প গ্রহণ করা যায় এবং দুটি প্রকল্প সমান্তরালভাবে চলে, তাহলে কর্ডলাইনটি শুধু ব্রড গেজ করা যেতে পারে। এতে মিটার গেজ অংশের নির্মাণ ব্যয় হ্রাস পাবে।
ঢাকার ধীরাশ্রমে কনটেইনার ডিপো স্থাপন জরুরি। কারণ চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বর্তমানে দেশের নৌবাণিজ্যের ৯৮ শতাংশ কনটেইনার পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয়। বর্তমানে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন-সংলগ্ন আইসিডির ধারণক্ষমতা ৯০ হাজার টিইইউএস। স্থানাভাবে এর ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব নয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ৭০ শতাংশ কনটেইনার ঢাকা অভিমুখে পরিবহন করা হয়, যার মাত্র ১০ শতাংশ রেলওয়ে পরিবহন করে। রেলওয়ের মাধ্যমে কনটেইনার পরিবহনের এই হার বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হলে কমলাপুর আইসিডির কনটেইনার ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যাবে। তাই ক্রমবর্ধমান কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য গাজীপুরের ধীরাশ্রমে নতুন একটি আইসিডি নির্মাণ করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
ঢাকার কমলাপুরে আগত অধিকাংশ কনটেইনার রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের অ্যাক্সেসরিজ বা কাঁচামাল বহন করে। ঢাকায় দিনের বেলায় ট্রেইলার ও লং ভেহিকল চলাচল নিষিদ্ধ থাকায় এসব পণ্য ডেলিভারি নিতে প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা দেরি হয়। টঙ্গী, পূবাইল, আশুলিয়া, সাভার ইত্যাদি এলাকায় সিংহভাগ গার্মেন্ট কারখানা অবস্থিত হওয়ার কারণে কমলাপুর থেকে এসব স্থানে পণ্য পরিবহনে যানজট ও অন্যান্য কারণে প্রচুর সময় ক্ষেপণ হয়। একই কারণে কনটেইনার রপ্তানির ক্ষেত্রেও বিলম্ব হয়। ধীরাশ্রমে আইসিডি নির্মাণ করা হলে ওই এলাকার কারখানাগুলোর অর্থ ও সময় সাশ্রয়সহ কনটেইনার আমদানি-রপ্তানি অনেক সহজ হবে।
অতিরিক্ত সচিব (অব.) ও সাবেক রেলওয়ে কর্মকর্তা। zakir.ahsan72@gmail.com
Leave a Reply