সংশ্লিষ্টরা জানান, চট্টগ্রাম থেকে নৌপথে দেশের বিভিন্ন জেলায় প্রায় ১ হাজার ৬০০ লাইটার জাহাজ চলাচল করে। এখানে প্রায় ৫০ হাজার শ্রমিক এবং সারাদেশে মোট দুই লাখ শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। ধর্মঘটের কারণে বন্দরের বহিনোঙরে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। বহিনোঙরে অর্ধশতাধিক বড় জাহাজ রয়েছে। নদীপথে পণ্যবাহী কোনো নৌ-যান চলাচল করছে না। শ্রমিকরা জোর করে কাজ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে লাইটার জাহাজ চলাচল বা পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। এ কারণে কর্ণফুলী নদীসহ বিভিন্ন নিরাপদ স্থানে অলস বসে আছে লাইটার, ট্যাংকার, বাল্ক হেডগুলো। শুধু যাত্রীবাহী নৌ-যান কর্মবিরতির বাইরে রাখা হয়েছে। তবে ধর্মঘটের কোনো প্রভাব পড়েনি কন্টেইনার জেটিগুলোতে। সেখানে কন্টেইনারবাহী জাহাজ থেকে কন্টেইনার ওঠানামা কাজ চলছে।
সাধারণত বিদেশ থেকে বড় কর্গো জাহাজে গম, ভুট্টা, ডাল, সার, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকার, পাথর, কয়লা, ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন খোলাপণ্য আমদানি করা হয়। এসব জাহাজ কর্ণফুলী নদীর গভীরতা কম থাকায় সরাসরি জেটিতে ভিড়তে পারে না। তাই বহিনোঙরে অপেক্ষমাণ রেখে ছোট জাহাজে (লাইটার) খালাস করা হয়।
নৌ-যান শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সম্পাদক নবী আলম বলেন, সোমবার রাত ১২টা থেকে সমস্ত লাইটার বন্ধ রাখা হয়েছে। যতক্ষণ ১১ দফা দাবি মানা হবে না ততক্ষণ ধর্মঘট চলবে। দুই বছর ধরে আমাদের এ আন্দোলন চলছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ লাইটারেজ শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শাহাদাত হোসাইন বলেন, সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত আমরা সরকারি বিভিন্ন সংস্থা, জাহাজ মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়ন ঢাকায় ত্রিপাক্ষিক আলোচনা করেছি। কোন সমস্যার সমাধান হয়নি। তাই পূর্বঘোষিত কর্মবিরতি অনির্দিষ্টকাল চলবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক জানান, বহিনোঙরে লাইটার জাহাজ চলাচল না করলেও বন্দরের মূল জেটি কন্টেইনার ও কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের কাজ চলছে। বন্দর থেকে লরি, ট্রাক, কাভার্ডভ্যানে পণ্য ও কন্টেইনারে ডেলিভারিও স্বাভাবিক রয়েছে।
নৌ-যান শ্রমিকদের দাবির মধ্যে আছে- সমুদ্র ও রাত্রিকালীন ভাতা নির্ধারণ, ভারতগামী শ্রমিকদের ল্যান্ডিং পাস ও মালিক কর্তৃক খাদ্য ভাতা প্রদান, বাল্কহেডসহ সব নৌ-যান ও নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধ করা, ২০১৬ সালের গেজেট অনুসারে বেতন দেওয়া, কর্মস্থলে দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের ক্ষতিপূরণ ১০ লাখ টাকা করা।
উল্লেখ্য, গত ১৩ অক্টোবর রাজধানীতে নৌ-শ্রমিক অধিকার সংরক্ষণ ঐক্য পরিষদের মানববন্ধন থেকে ১১ দফা দাবিতে এই ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। এরই প্রেক্ষিতে গত সোমবার রাত ১২টা এক মিনিটে সারাদেশে একযোগে নৌ ধর্মঘট শুরু হয়। এর আগে সারাদেশে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি ঘোষণা করেছে নৌ-যান শ্রমিক ফেডারেশন।
এদিকে শতবর্ষী বাণিজ্য সংগঠন চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি মাহবুবুল আলম নৌ-যান শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রত্যাহারে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিতে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের প্রতি আহব্বান জানিয়েছেন। গতকাল মঙ্গলবার পাঠানো এক চিঠিতে তিনি এ আহব্বান জানান।
চেম্বার সভাপতি বলেন, সোমবার সন্ধ্যা থেকে নৌ-যান শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট পালন করছে। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহিনোঙরে শিল্পের কাঁচামাল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য খালাস বন্ধ রয়েছে। লাইটারেজ জাহাজ চলাচল না করায় সারাদেশে এসব কাঁচামাল ও পণ্য পরিবহন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি বন্দরে জাহাজজট নতুনভাবে সংকট তৈরি করছে। জাহাজের টার্ন অ্যারাউন্ড টাইম বৃদ্ধি এবং ডেমারেজ চার্জসহ পণ্য আমদানি-রপ্তানি ব্যয় বাড়বে। এর ফলে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এবং সাধারণ ভোক্তাদের অতিরিক্ত মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী কিনতে হবে। বিশ্ব মহামারী করোনা ভাইরাসের এ সময়ে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত সাধারণ মানুষ আরো চাপের মুখে পড়বে। অর্থনীতির গতিধারা পুনরুদ্ধারে কার্যক্রম পরিচালনাকারী ব্যবসায়ীরা নতুন করে অস্তিত্বের সংকটে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেবে বলে মনে করেন চেম্বার সভাপতি।
চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ ধরনের ধর্মঘট অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেশি ক্ষতিকর। এতে করে শিল্পোৎপাদন ব্যাহত হবে এবং সারা দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। ফলে বাজার অস্থিতিশীল হবে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে যাবে যা সামষ্টিক ও ব্যাষ্টিক উভয় পরিসরে অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
করোনা মহামারীর আগ্রাসন থেকে ধীরে ধীরে অর্থনীতির চাকা পুনরুদ্ধারে চলমান আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নির্বিঘ্ন রাখা, বন্দরে জাহাজজট নিয়ন্ত্রণ রাখা, শিল্পের কাঁচামাল সরবরাহ অব্যাহত রাখা এবং আমদানি করা ভোগ্যপণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সারাদেশে পরিবহন স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষ থেকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রীর প্রতি আহবান জানান চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম।
Leave a Reply