মহামারি নিয়ন্ত্রণের সুযোগে ভিয়েতনাম দ্রুত ব্যবসা-বাণিজ্য চালু করতে সক্ষম হয়। ফলে দেশটি এ বছরের দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হতে যাচ্ছে। মহামারির কারণে বিশ্বের অনেক দেশের অর্থনীতি সংকোচনের শিকার হলেও ভিয়েতনাম ৩ শতাংশ বার্ষিক গতিতে উন্নতি করছে। বিশ্ববাণিজ্যে ধস সত্ত্বেও রেকর্ড পরিমাণ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত দিয়েই প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে দেশটি।
প্রকৃত এশিয়ান মিরাকলগুলো যেভাবে আবির্ভূত হয়েছিল, ভিয়েতনামকে একই পথ অনুসরণ করতে হচ্ছে একেবারে নতুন একটি যুগে এসে। যে পরিস্থিতিতে প্রকৃত মিরাকল ঘটনা সম্ভব হয়েছিল, তা এখন নেই। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি এখন ধীরগতিতে চলছে। ফলে আগের মিরাকল কৌশলগুলো এখন আর অগ্রাহ্য করছে না পরাশক্তিগুলো। তাইতো গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ এনেছে, ভিয়েতনাম কারেন্সি ম্যানিপুলেশন করছে এবং চীনের বিরুদ্ধে যে শুল্ক যুদ্ধের (ট্যারিফ ওয়ার) সূচনা ঘটিয়েছিল—সেই একই ধরনের তদন্ত ভিয়েতনামের বিরুদ্ধেও শুরু করেছে। এই বৈশ্বিক হুমকি ছাড়াও দেশটির অব্যাহত প্রবৃদ্ধির জন্য আরো বড় হুমকি হচ্ছে প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে চলে আসা একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। কারণ বিরোধিতা না থাকলে বাতিকগ্রস্ত শাসনব্যবস্থা বিভ্রান্তিকর ‘বুম অ্যান্ড বাস্ট সাইকেল’ (অর্থনীতির উত্থাপন পতনচক্র) তৈরি করে, যা উন্নয়নকে থামিয়ে দেয়।
প্রকৃত ‘এশিয়ান মিরাকল’ রাষ্ট্রগুলো তাদের উত্থানের বছরগুলোতে বার্ষিক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রায় ২০ শতাংশের কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিল। ২০১০-এর দশকে বিশ্ববাণিজ্য মন্দায় আক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও ভিয়েতনামের রপ্তানি প্রতিবছর ১৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়।
অন্যান্য উদীয়মান রাষ্ট্রগুলো যখন ভোটারদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টায় সমাজকল্যাণে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে, তখন ভিয়েতনাম রপ্তানি বৃদ্ধি, বিদেশি বিনিয়োগ আহরণে রাস্তাঘাট ও বন্দর উন্নয়ন এবং শ্রমিকদের শিক্ষিত করতে স্কুল নির্মাণে সম্পদ ব্যয় করছে। সরকার প্রতিবছর জিডিপির প্রায় ৮ শতাংশ বিনিয়োগ করছে নির্মাণ প্রকল্পগুলোতে এবং উন্নয়নের একই পর্যায়ে থাকা অন্যান্য জাতির তুলনায় তারা অবকাঠামোর গুণগত মানের জন্যও উচ্চতর মানও অর্জন করেছে। বৈদেশিক অর্থও একই পথে পরিচালিত হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগের বেশির ভাগই যাচ্ছে উৎপাদন কারখানা ও সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো খাতে এবং এর বেশির ভাগ আসছে সহযোগী এশীয় দেশ দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও চীন থেকে।
সস্তা মজুরি সন্ধানে চীনকে বাদ দিয়ে ভিয়েতনাম এখন রপ্তানিপণ্য উৎপাদকদের প্রিয় গন্তব্য। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকের তুলনায় দেশটির বার্ষিক গড় মাথাপিছু আয় তিন গুণ বেড়ে প্রায় তিন হাজার মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। অথচ এখন দেশটিতে শ্রমের মূল্য চীনের অর্ধেক এবং তাদের জনশক্তিও অস্বাভাবিকভাবে সুশিক্ষিত। এই দক্ষ শ্রমিকরাই ভিয়েতনামকে ওপরে তুলে দিচ্ছে এবং ক্রমবর্ধমান অত্যাধুনিক পণ্য উৎপাদনে সহায়তা করছে।
এই রক্ষণশীল যুগে উন্মুক্ত সীমান্তের কমিউনিস্ট চ্যাম্পিয়ন ভিয়েতনাম এখন বিশ্ববাণিজ্যে একটি নমনীয় দেশও। ভিয়েতনাম এখন এক ডজনের বেশি মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরকারী দেশ, যার সর্বশেষটি হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে। প্রশ্ন হচ্ছে, স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের ভিয়েতনাম কি তার এই সাফল্য ধরে রাখতে পারবে? সম্ভবত পারবে। এখন পর্যন্ত দেশটির সরকার এমন ধরনের কোনো মারাত্মক নীতিগত ভুল করেনি, যা সাধারণত স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করে।
লেখক : বিনিয়োগকারী ও লেখক।
ভাষান্তর : আফছার আহমেদ।
Leave a Reply