একসময় তিউনেশিয়া থেকে লিবিয়া হয়ে লোহিত সাগরের পশ্চিম উপকূল ছিল বিখ্যাত অটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। আফ্রিকার নাইজার নদীর তীরে ছিল বিখ্যাত তুকোলোর সাম্রাজ্য ও সোকোতো সাম্রাজ্য। কিন্তু ইউরোপে শিল্প বিপ্লবের শতবছর পর ইউরোপিয়ান বাজার খুঁজতে মরিয়া হয়ে উঠে। তখন তারা বিখ্যাত স্কটিশ মিশনারি ডেভিড লিভিংস্টোনের দাসপ্রথায় জর্জরিত আফ্রিকানদের ‘সভ্য’ করার ধারণাকে লুফে নেয়। ১৮৮৪-১৮৮৫ সালে বার্লিন সম্মেলন করে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে আফ্রিকা দখলের লড়াই শুরু করে ইউরোপিয়ানরা। ১৯১২ সালের মধ্যে ইথিওপিয়া ও লাইবেরিয়া ছাড়া পুরো আফ্রিকা দখল করে নেয় ইউরোপের সাত দেশ ফ্রান্স, ব্রিটেন, পর্তুগাল, জার্মানি, স্পেন ও বেলজিয়াম। সময়ের প্ররিক্রমায় বেশীর ভাগ বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ও শেষভাগে স্বাধীনতা পেলেও ফ্রান্সের দখল করা ২৪ দেশের মধ্যে ১৪ দেশে এখনো চলছে ফ্রান্সের শোষণ। টোগো, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, গিনি বিসাউ, সেনেগাল, আইভরিকোস্ট, মালি, নাইজার, চাদ, ক্যামেরুন, মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র, কঙ্গো (ব্রাজাভিলা), নিরক্ষীয় গিনি ও গ্যাবনসহ ১৪ দেশকে বলা হয়ে থাকে ফ্রান্সফ্রিকা বা ফ্রাংক জোন।
এসব দেশের জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশই এখনো জমা রাখতে হয় ফ্রান্সে। আর তাদের আয়ের প্রায় ২০ শতাংশই ব্যয় করতে ফ্রান্সের নানা দেনা মেটাতে। দেশ চালাতে অর্থের প্রয়োজন হলে তাদের অর্থই ফ্রান্সের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। এই ১৪টি দেশকে ব্যবহার করতে হয় ফ্রান্স নিয়ন্ত্রিত মুদ্রা ফ্রাংক। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ফ্রান্সের মুদ্রা দুর্বল হয়ে পড়লে দেশগুলোকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে ট্রেজারিতে সম্পদ রাখা ও ফ্রাংক ব্যবহার করার চুক্তি করিয়ে নেয় ফ্রান্স।
বলা হয়ে থাকে জাতিসংঘে ফ্রান্সের পক্ষে ভোট বাড়াতেই এসব দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখে নামমাত্র স্বাধীনতা দিয়েছে ফ্রান্স। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট (১৯৫৯-১৯৬৯) দ্য গল এসব পরিকল্পনার মূলহোতা। দ্যা গলের ঘনিষ্ট বন্ধু ও ব্যবসায়ী জ্যাক ফোকার্ট ফ্রান্স ও আফ্রিকার রাজনীতিবিদদের নিয়ে ‘ফ্রান্সফ্রিকা’ নামে একটি নেটওয়ার্ক দাঁড় করান। এই নেটওয়ার্কের কাজ ছিল আফ্রিকা জুড়ে ক্যু, রাজনৈতিক হত্যাকান্ড ও কারচুপির নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের উত্থানকে দমিয়ে রাখা। সিলভানাস অলিম্পিতে ১৯৬৩ সালে টোগোতে নিজস্ব মুদ্রা চালুর লক্ষ্যে জাতীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কিন্তু তারপরের দিন ফ্রান্সের প্রশিক্ষিত স্বদেশীরা তাকে হত্যা করেন। ১৯৬৩ সালের পর থেকে ফ্রান্সফ্রিকার ১৪ দেশে ২২ জন সরকার প্রধানকে হত্যা করা হয়। প্রত্যেকটি হত্যাকান্ডের পেছনে কলকাঠি নেড়েছে ফ্রান্সের গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএসই।
ফ্রান্স প্রাকৃতিক সম্পদের জন্য আফ্রিকার উপর নির্ভরশীল। ফ্রান্সের বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চারভাগের তিনভাগ পারমাণবিক বিদ্যুতৎ কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রের কাঁচামাল ইউরোনিয়ামের বড় যোগানদাতা গ্যাবন, মালিসহ আফ্রিকার দেশগুলো। তাই গ্যাবনে দশকের পর দশক ধরে ফ্রান্স বসিয়ে রেখেছে তার পুতুল সরকার। বলা হয়ে থাকে বিনিয়োগের জন্য ফ্রান্সের জন্য নির্ভরশীল এসব দেশ। কিন্তু আসলে এসব দেশের জমাকৃত অর্থই ফ্রান্স নিজের নামে বিনিয়োগ করে। কলোনি থাকার সময় ফ্রান্স আফ্রিকাতে যে অবকাঠামো নির্মাণ করেছিল তার ঋণ ও ভাড়া দিতে হয় ফ্রান্সকে। রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রক্ষমতায় ফ্রান্সের পুতুল সরকার প্রতিষ্ঠায় অন্যান্য দেশ থেকেও বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারে না দেশগুলো। চীন ঘেঁষা আইভেরি কোস্টের প্রেসিডেন্ট লঁরা বেগবো একটি সেতু গড়তে চেয়েছিলেন। এই সেতু নির্মাণে ফরাসি একটি সংস্থা মার্কিন ডলারে একটি দাম হাঁকে। কিন্তু তা অর্ধেক দাম হাঁকে চীনা প্রতিষ্ঠান। তারা অর্থ পরিশোধের সুযোগ দিয়েছিল আইভরি কোস্টের প্রাকৃতিক সম্পদ কোকো বিন দিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লঁরা বেগবোকেই ক্ষমতা থেকে সরে যেতে হয়।
ফ্রান্স যেমন আফ্রিকার প্রাকৃতিক সম্পদ ইউরোনিয়াম, স্বর্ণ, জ্বালানি, কফির উপর একচেটিয়া দখলদারিত্ব বজায় রেখেছে তেমনি বিনিয়োগের উপরও। ফ্রাংক ব্যবহারকারী ১৪টি দেশের জল বিদ্যুৎ, টেলিফোন, পরিবহন, ব্যাংক, কৃষি, নির্মাণ শিল্প সবই ফ্রান্সের নিয়ন্ত্রণে। গৃহযুদ্ধ চলছিল মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে। ফ্রান্সের অনুগত বনাম বিরোধী দলের মধ্যে। রাজধানী বাঙ্গুই বিমানবন্দরে মাত্র ৩০০ সৈন্য পাঠিয়ে ক্ষমতা দখল করে দেয় ফ্রান্স। অন্যতম সম্পদশালী দেশ মালি। মালির ইউরোনিয়ামের পুরোটাই যায় ফ্রান্সে। এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম সোনা উৎপাদনকারী দেশ। চলতি দশকের শুরুতে শ’তিনেক মাফিয়া ও বিদ্রোহীদের হাত থেকে সোনার খনি রক্ষার কথা বলে ৪ হাজার ফরাসি সৈন্য ঘাঁটি গড়ে বসেছে মালিতে। এছাড়া জিবুতি, গ্যাবন , সেনেগালেও সামরিক ঘাঁটি রয়েছে ফ্রান্সের। ২০১১ সালের কথিত আরব বসন্তের প্রাক্কালে লিবিয়ার গাদ্দাফির বিরোধীদের প্রথম সমর্থন দেয় ফ্রান্স। তার অন্যতম কারণ গাদ্দাফির আপোষহীন মানসিকতা ও আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের নেতৃত্ব দেওয়া ফ্রান্সের উপনিবেশে ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
এলফ কেলেঙ্কারির কথা বিশ্বের তেল রাজনীতিতে তোলপাড় তৈরি করেছিল। ফ্রান্সের বিখ্যাত তেল কোম্পানি টোটালের পূর্ব নাম ছিল এলফ। এই এলফ কোম্পানিকে বলা হতো ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতির গোপন অস্ত্র। এই কোম্পানী নামমাত্র মূল্যে আফ্রিকা থেকে তেল নিতো আর ফ্রান্সের নির্দেশে আফ্রিকার নানা রাজনীতিবিদকে অর্থ প্রদান করত। ১৯৯৪ সালে আলোচনায় আসা এই কেলেঙ্কারিকে ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় প্রতারণা’ বলে অবহিত করেছিল।
তবে ওয়ান রোড ওয়ান বেল্ট প্রকল্প নিয়ে ফ্রান্সফ্রিকা বা ফ্রাংক জোনের দেশে বিনিয়োগে ভাগ বসাতে যাচ্ছে চীন। ১৯৯৫ সালের হিসাবে এই ১৪টি দেশে বিনিয়োগে প্রথম ছিল ফ্রান্স। কিন্তু ২০১৭ সালের হিসাবে ১৪ টির মধ্যে ৪টি দেশে প্রথম ও ২টি দেশে দ্বিতীয় প্রধান বিনিয়োগকারিতে পরিণত হয়েছে চীন। আফ্রিকায় ফ্রান্সের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে তুরস্ক। আলজেরিয়া, গাম্বিয়া, সেনেগাল, গ্যাবন, মৌরতানিয়া, মালি, সোমালিয়া ও লিবিয়ার সাথে তুরস্কের বিনিয়োগ ও রাজনৈতিক সম্পর্ক বাড়ছে। এরমধ্যে গ্যাবন, সেনেগাল মালি ফ্রাংক জোনের দেশ ২০০৮ সালের আফ্রিকা-তুর্কি সম্মেলন ও ২০১৮ সালের আফ্রিকা-চীন সম্মেলন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। তুরস্ককে যে ভূমধ্যসাগরে থামিয়ে দিতে ফ্রান্সের তোড়জোড় চলছে তার অন্যমত কারণ তুরস্কের আফ্রিকায় পা বাড়ানো। আফ্রিকাজুড়ে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের বিনিয়োগ পরিকল্পনা বুঝতে পেরে ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ‘প্রেসিডেন্সিয়াল কাউন্সিল অব আফ্রিকা’ গঠন করে তাদের আফ্রিকা নীতি নিয়ে নতুন করে ভাবছে। তবে ফ্রাংক দেশসমূহের প্রকৃত স্বাধীনতা ঢের দেরি। কেননা স্বদেশীরাই বসে আছে ফ্রান্সের স্বার্থ রক্ষায়। উৎস : বনিক বার্তা।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahadatju44@gmail.com
Leave a Reply