প্রতিবছর নতুন নতুন সড়ক প্রকল্প নেওয়া হয়। বছর না ঘুরতেই নির্মাণ করা ওই সড়কের কোনো কোনো অংশ ভেঙেচুরে একাকার হয়ে পড়ে। সাধারণত জাতীয় মহাসড়কের পেভমেন্টের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ বছর। যান চলাচলে বার্ষিক ১০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে ‘রোড পেভমেন্ট ডিজাইন গাইডলাইন-২০০৫’ অনুযায়ী এ আয়ুষ্কাল নির্ধারণ করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ); কিন্তু মূল সড়কের কোনো আয়ুষ্কাল ধরা হয় না বা সড়কের যেসব প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করা হয়, সেখানেও আয়ুষ্কাল থাকে না।
এ বাস্তবতায় সড়কের আয়ুষ্কাল নির্ধারণের জন্য কাজ করছে সওজ। পাশাপাশি সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে একটি নীতিমালা হচ্ছে। সড়কের কাজের মান নিশ্চিত করাসহ ঠিকাদার-প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতা বাড়ানো হবে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালা প্রস্তুত হয়েছে। এ নিয়ে আজ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের কথা থাকলেও গত রাতে তা স্থগিতের খবর আসে।
এদিকে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে তহবিল গঠনে কাজ করছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। ফান্ডের মাধ্যমে সড়ক মেরামতে আর্থিক সংকট ঘুচবে বলে ধারণা করছে সওজ। কারণ বর্তমানে সড়ক মেরামতে বরাদ্দের অভাবে কঠিন হয়ে পড়ে। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালায় অর্থের উৎস জোগাড়ের কথা বলা হয়েছে।
অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার ব্যয় করলেও নির্মাণকাজ মানসম্পন্নভাবে না হওয়ায় এসব বিনিয়োগ থেকে দেশের জনগণ আশানুরূপ সুফল পাচ্ছে না। বর্তমানে প্রকল্প ছাড়াও মেইনটেন্যান্সের আওতায় সড়ক নির্মাণ-মেরামত করা হয়। অর্থ বরাদ্দ তথা বা সময়মতো অর্থ ছাড়ের অভাবে সড়কের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কঠিন হয়ে পড়ে। তাই ফান্ড গঠনের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। এ ছাড়া সড়ক থেকে টোল আদায়ের পৃথক সিদ্ধান্ত রয়েছে। কেবল নতুন প্রকল্প নয়, টেকসই সড়ক নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণে জোর দিতে চাইছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। কারণ দেশের সড়ক বা মহাসড়কগুলো নির্মাণের পর বেশি দিন টিকছে না। খানাখন্দ আর কার্পেটিং উঠে যান চলাচলের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে। অনুমোদিত সীমার অতিরিক্ত ভার বহন, অতিবৃষ্টি, সড়কে বৃষ্টির পানি জমে যাওয়া এবং ত্রুটিপূর্ণ ও মানহীন নির্মাণের কারণে সড়ক টেকসই হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

সূত্রমতে, ‘সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালা ২০২০’-এর খসড়ায় সওজের ২২ হাজার ২৯৫ কিলোমিটার সড়ক রয়েছে। এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ করে টেকসই নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতেই সরকার নীতিমালা করেছে। সঠিক সময়ে সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ কাজের মাধ্যমে ব্যয় কমানো ও সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ এবং মেরামত খাতে বরাদ্দ অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে জোর দেওয়া হয়েছে নীতিমালায়। এ জন্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ ও কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণে বিকল্প অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধানের কথাও বলা হয় সেখানে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সড়ক অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণে সুবিধাভোগী যেমন- সড়ক ব্যবহারকারী এবং অংশীজনের সম্পৃক্ততা উৎসাহিত করা। মানে পরিবহন সেক্টরে জড়িতদের সঙ্গে নিয়ে নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ দেখতে চায় সওজ। এতে অতিরিক্ত ওজনের বাহন চলাচল রোধ করাসহ কিছু সুফল মিলতে পারে বলে তাদের ধারণা। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে ২০১৮ সালে বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সমন্বয়কের সভাপতিত্বে। এ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়নে কমিটি গঠনের পর খসড়াটি সম্প্রতি প্রস্তুত করা হয়। এখন মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের মাধ্যমে নীতিমালাটি চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে।
সওজের প্রধান প্রকৌশলী কাজী শাহরিয়ার হোসেন বলেন, সড়কের রক্ষণাবেক্ষণে গুরুত্ব দিতেই নীতিমালা হচ্ছে। সড়ক স্থায়িত্ব, রক্ষণাবেক্ষণে বাধা দূর এবং তাৎক্ষণিক মেরামত নিশ্চিত করাসহ নানা বিবেচনায় নীতিমালা প্রস্তুত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ নীতিমালার আওতায় সওজের অধীন সড়ক, সেতু ও অন্য সড়ক অবকাঠামো থাকবে। রক্ষণাবেক্ষণ হবে ক্যারিজওয়ে, শোল্ডার, সড়কবাঁধ এবং বার্মসহ সম্পূর্ণ রাইট অব ওয়ে- এর যে কোনো ধরনের রক্ষণাবেক্ষণ। তা ছাড়া সেতু, কালভার্ট, উড়ালসেতু, টানেল, ফুটওভারব্রিজ, আন্ডারপাস, ওভারপাসসহ সব সড়ক অবকাঠামো এবং সংযোগ সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। থাকবে সড়ক ও সেতুর নিষ্কাশন ব্যবস্থা। শুধু তা-ই নয়, সড়ক ব্যবহারীদের নিরাপত্তায় দৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা অপসারণ, নিরাপত্তা বেষ্টনী, প্রয়োজনীয় সাইন, সিগন্যাল, সড়ক মার্কিং, দূরত্ব সম্পর্কিত তথ্য ও নির্দেশনা রক্ষণাবেক্ষণের আওতাভুক্ত থাকবে। রুটিন ও পিরিয়ডিক এই ক্যাটাগরিতে রক্ষণাবেক্ষণ আওতাভুক্ত। রুটিন রক্ষণাবেক্ষণ মানে হচ্ছে- সড়ক অবকাঠামোর কার্যকারিতা বজায় রাখা। এজন্য বছরে এক বা একাধিকবার কাজ করা হবে। সড়ক সারফেসে পটহোল মেরামত, ফাটল ভরাট, আনডিউলেশন মেরামত, সড়কের প্রান্ত মেরামত, সোল্ডার মেরামত, বাঁধ মেরামত, বৃক্ষ অপসারণ, ড্রেইন-কালভার্ট পরিষ্কার, সাইন-সিগন্যাল মেরামত, রোড সেফটি উপকরণ মেরামত। মেরামত কাজে নতুন ধরনের উদ্ভাবনী কাজের পরীক্ষামূলক প্রয়োগ রুটিন রক্ষণাবেক্ষণের আওতাভুক্ত। আর পিরিয়ডিক রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে- বড় ধরনের মেরামত করা। মানে প্যাচ রিপেয়ার, সিলকোট, সিঙ্গেল বিটুমিনাস সারফেস ট্রিটমেন্ট, ডাবল বিটুমিনাস সারফেস ট্রিটমেন্ট, থিন ওভারলে, মেইনটেনেন্স ওভারলে। এগুলো বছরে বা কয়েক বছরের বিরতিতে করতে হবে। এজন্য সড়ক সারফেস নবায়ন করে কার্যোপযোগিতা পুনঃস্থাপন করা হবে। সড়ক সারফেস নবায়নের জন্য প্রয়োজনে নিচের স্তরে মেরামত করা লাগতে পারে। সড়কবাঁধে ভাঙন থাকলে প্রযোজনীয় মেরামত যেমন- ভরাট, প্যালাসাইডিং বা অন্য প্রতিরক্ষামূলক কাজ করা লাগবে। এই পিরিয়ডিক কাজ মেজর ও মাইনর দুই ধরনের হবে। এ ছাড়া রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় জরুরি প্রয়োজনে কাজ করা লাগতে পারে। প্রাকৃতিক বা অপ্রত্যাশিত দুর্যোগ কিংবা দুর্ঘটনা এর আওতায় পড়ে। এর বাইরে বিশেষ রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। অপেক্ষাকৃত বড় ধরনের কাজ এর আওতায় পড়ে। মজবুতিকরণ, পুনর্নির্মাণ, নতুন ড্রেইন নির্মাণ, সড়কের বাঁক সরলীকরণ, সুপার এলিভেশন সঠিককরণ বিশেষ কাজের অধীনে পড়ে বলে নীতিমালার খসড়ায় বলা হয়েছে।
Leave a Reply