বাংলাদেশে চলাচল করে এমন ফিডার জাহাজ মালিকরা একজোট হয়ে জাহাজে কন্টেইনার পরিবহনের ভাড়া একতরফা বাড়িয়ে দিয়েছেন। সিঙ্গাপুর, কলম্বো এবং পোর্ট কেলাংয়ে জাহাজজটের কারণে তাদের অতিরিক্ত তিন-চার দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে এবং সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ‘ইমার্জেন্সি কস্ট রিকভারি সারচার্জ’ নামে এই ভাড়া বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন ফিডার অপারেটররা। আগামী ১৫ নভেম্বর থেকে বর্ধিত ভাড়া কার্যকর করা হবে। ফিডার মালিকদের এই সিদ্ধান্তে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে একে অশনিসঙ্কেত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ট্রেড বডি নেতারা। পণ্য পরিবহনে খরচ বেড়ে গেলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশীয় বাজারে, যা ভোক্তা সাধারণের ঘাড়েই চাপবে। তাই জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধির একতরফা সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন নেতারা। ফিডার অপারেটররা তাদের জাহাজে কন্টেইনার পরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মেইন লাইন অপারেটরদের (এমএলও) কাছে জানায়। এমএলওরা তা তাদের শিপিং এজেন্টদের ফরোয়ার্ড করলে বিষয়টি নিয়ে ব্যবসায়ী মহলে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরে বছরে ৩২ লাখ টিইইউস কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হচ্ছে। প্রতিদিন গড়ে ৮ হাজার কন্টেইনার হ্যান্ডলিং হয়। মাসে মোট কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ২ লাখ ৪০ হাজার বা তারও বেশি। ফিডার অপারেটরদের ভাড়া বৃদ্ধির ফলে এসব কন্টেইনারে যেসব আমদানি পণ্য আসছে এবং রফতানি পণ্য যাচ্ছে তাতে মাসে অতিরিক্ত ব্যয় হবে পৌনে ২ কোটি ডলার।
শিপিং এজেন্ট সূত্র জানান, চট্টগ্রাম-সিঙ্গাপুর, চট্টগ্রাম-কলম্বো এবং চট্টগ্রাম-পোর্ট কেলাং রুটে এখন ৮২টি ফিডার জাহাজ কন্টেইনার পরিবহন কাজে নিয়োজিত। এর কিছু জাহাজ কন্টেইনার চালান থাকাসাপেক্ষে মোংলা বন্দরেও চলাচল করে। ৮২টি জাহাজের মধ্যে বাংলাদেশি পতাকাবাহী জাহাজ রয়েছে মাত্র দুটি, এইচআরসি শিপিং লাইন্সের। বাকি সব জাহাজ পিআইএল, ওইএল, মার্কস শিপিং, সি কনসোর্টিয়াম, সামুদারা ইত্যাদি কোম্পানির মালিকানায় বিদেশি পতাকাবাহী। সিঙ্গাপুর রুটে পণ্যবাহী কন্টেইনার প্রতিটির (এক টিইইউস) ভাড়া ৭৫ ডলার এবং খালি কন্টেইনার বহনের ভাড়া ৩৭ ডলার করে বাড়ানো হয়েছে। তা কার্যকর হবে ১৫ নভেম্বর থেকে। চট্টগ্রাম-কলম্বো রুটে ভাড়া বাড়বে ১৬ নভেম্বর থেকে পণ্যবাহী কন্টেইনারে ৭৫ ডলার এবং খালিতে ৩৫ ডলার করে। একই হারে চট্টগ্রাম-পোর্ট কেলাং (মালয়েশিয়া) রুটে ভাড়া বাড়বে ২০ নভেম্বর থেকে।
বাংলাদেশ থেকে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কন্টেইনারে পণ্য আমদানি ও রফতানির মোট পরিমাণের ৪৪ শতাংশ আসে-যায় সিঙ্গাপুর বন্দর হয়ে, ৩৭ শতাংশ শ্রীলঙ্কার কলম্বো পোর্ট হয়ে এবং ১৯ শতাংশ মালয়েশিয়ার পোর্ট কেলাং ও তানজং পেলাপাস বন্দর হয়ে। মাদার ভেসেলে আসা কন্টেইনার এসব বন্দর থেকে বোঝাই করে চট্টগ্রাম নিয়ে আসে ফিডার জাহাজ। আবার চট্টগ্রাম থেকে পণ্যবাহী ও খালি কন্টেইনার নিয়ে এসব বন্দরে খালাস করে। সেখান থেকে মাদার ভেসেলে তুলে পাঠানো হয় গন্তব্যে।
বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (বিএসএএ) চেয়ারম্যান আহসানুল হক চৌধুরী জানান, করোনা মহামারির কারণে স্থবির হয়ে পড়া বিশ্ববাণিজ্য হালে চাঙ্গা হয়ে ওঠায় সিঙ্গাপুর, কলম্বো এবং কেলাং পোর্টে জাহাজের জট লেগে গেছে। আগে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গিয়ে দিনে দিনে কন্টেইনার খালাস করে পরদিন ফিরতি ভয়েজ নিয়ে যাত্রা করতে পারত। এখন জটের কারণে তিন-চার দিন বেশি অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এতে দৈনিক ১০ হাজার ডলারের মতো ডেমারেজ গুনতে হচ্ছে জাহাজ মালিকদের। সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতেই ফিডার অপারেটররা কন্টেইনার পরিবহন ভাড়া সাময়িকভাব বাড়ানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন। আমরা এতে খুবই উদ্বিগ্ন। এটি বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্যের জন্য অশনিসঙ্কেত বলে আমরা মনে করছি।
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম জানান, এমনিতেই ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্প-কারখানার পরিস্থিতি করুণ। সে অবস্থায় ফিডার অপারেটরদের একতরফা ভাড়া বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’। সিঙ্গাপুর বা কলম্বোতে জট হলে তার দায় আমরা কেন নেব। যে হারে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে তাতে ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হবেন। শেষ পর্যন্ত তার বোঝা গিয়ে পড়বে ভোক্তা সাধারণের ওপর। আমরা এ সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।
বিজিএমইএ’র প্রথম সহসভাপতি এমএ সালাম জানান, জাহাজে কন্টেইনার পরিবহন ভাড়া একতরফা বাড়িয়ে দেওয়ায় আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। এটা কার্যকর হলে তৈরি পোশাক শিল্প মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বে। বিশ্বব্যাপী এখন মন্দা চলছে। বায়াররা আমাদের রেট কমিয়ে দিচ্ছেন। আয় কমে গেছে অনেক। এ অবস্থায় ফিডার জাহাজে ভাড়া বৃদ্ধি নয়; বরং কমানোর বিষয় বিবেচনার জন্য আমরা দাবি জানাচ্ছি।
Leave a Reply