চীন থেকে ৬৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে আনা ২০ সেট ডেমু ট্রেনের অধিকাংশই চালানো হচ্ছে জোড়াতালি দিয়ে। প্রায় সময় নষ্ট থাকে। গতকালও ৩ সেট ডেমু মেরামতের জন্য কারখানায় ফেলে রাখতে দেখা গেছে। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে ডেমু ট্রেনগুলো একের পর এক নষ্ট হওয়ার ঘটনায় এ ট্রেন চালুর উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে। দিতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা ভর্তুকি। মাত্র ছয় বছরের ব্যবধানে ডেমু ট্রেনগুলো বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য বড় ধরনের বোঝা হয়ে গেছে। ডেমু ট্রেনে ব্যয় করা অর্থ দিয়ে ঢাকা চট্টগ্রাম রুটে চলাচল করে এমন অন্তত দশটি ট্রেন চালু করার সুযোগ ছিল।
রেলওয়ের পদস্থ কর্মকর্তারা জানান, যাত্রীসেবার মানোন্নয়ন ও যানজট নিরসনে কমিউটর ট্রেন সার্ভিস চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে ডিজেল ইলেকট্রিক মাল্টিপল ইউনিট- ডিইএমইউ (ডেমু) ট্রেন আমদানির সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু রেলওয়ের অপারেশন বিভাগ থেকে ডেমু ট্রেন আনার ব্যাপারে আপত্তি করা হয়। এ আপত্তি না শুনেই চীন থেকে ডেমু ট্রেন কেনার জন্য ২০১১ সালের ৪ আগস্ট চুক্তি করা হয়। ওই চুক্তির আলোকে ৬৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালে আমদানি করা হয় ডেমু ট্রেন। যার অধিকাংশই ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে।
কম সময়ে অধিকাংশ ট্রেন নষ্ট হওয়ার ঘটনাকে অস্বাভাবিক বলে মন্তব্য করেন রেলওয়ের কর্মকর্তারা। তারা বলেছেন, সাধারণত রেলের ইঞ্জিনের গড় আয়ু থাকে ২৫ বছর। আর বগির ক্ষেত্রে তা ২০ বছর। মেরামত করে ইঞ্জিন ও বগি নির্ধারিত মেয়াদের চেয়ে কয়েক বছর করে বেশি পরিচালনা করা হয়। রেলওয়ের বহরে বর্তমানে ত্রিশ বছরের পুরনো ইঞ্জিন চলছে। বগিও রয়েছে ২৬ বছর আগের। কিন্তু কম সময়ে ডেমু ট্রেনের বেহাল দশা সকলকেই ভাবিয়ে তুলেছে।
সূত্র বলেছে, ডেমু তৈরি হয়েছে স্বল্প দূরত্বে চলাচলের জন্য। কমিউটর ট্রেন হিসেবে শহরের ভিতরে বা উপশহরে চলাচল উপযোগী এসব ট্রেন ২০/৩০ কিলোমিটার দূরত্বে চলাচল করে। ডেমু ট্রেনের দুই দিকে দুটি ইঞ্জিন ও মাঝখানে একটি বগি। বগির পাশাপাশি ইঞ্জিনেও যাত্রী বহন করা যায়। সব মিলিয়ে এক সেট ডেমুতে বসে ১৪৯ জন ও দাঁড়িয়ে ১৫১ জন যাত্রী যাতায়াত করতে পারে। এক সেট ডেমুতে সর্বোচ্চ ৩০০ জন যাত্রী পরিবহনে সক্ষম। এর বেশি যাত্রী উঠলেই ডেমু চলাচল ঝুঁকির মুখে পড়ে।
নয়া এ ট্রেন চালুর শুরুতে রেলওয়ের লোকজন গুণে গুণে যাত্রী উঠালেও পরবর্তীতে সেই সিস্টেম ভেঙ্গে পড়ে।
অপরদিকে স্বল্প দূরত্বে চলাচল করার কথা থাকলেও শেষতক তা রক্ষা করা হয়নি।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অধীনে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের মধ্যে প্রথম ডেমু চালু করা হয়। ২০১৩ সালের মে মাসেই চট্টগ্রাম-লাকসাম রেলপথে এই ট্রেনে যাত্রী পরিবহন শুরু হয়। এই পথের দূরত্ব প্রায় ১৩০ কিলোমিটার। পর্যায়ক্রমে পূর্বাঞ্চলের সাতটি ও পশ্চিমাঞ্চলের তিনটি রুটে চলাচল করে। কমিউটার সার্ভিসের জন্য নির্ধারিত পূর্বাঞ্চলে রুটগুলো হলো ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা (৪ সেট), ঢাকা-ভৈরব-ঢাকা (২ সেট), ঢাকা-জয়দেবপুর-ঢাকা (২ সেট), চট্টগ্রাম-দোহাজারী-চট্টগ্রাম (২ সেট), চট্টগ্রাম-লাকসাম-চট্টগ্রাম (২ সেট), লাকসাম- নোয়াখালী-লাকসাম (১ সেট) ও লাকসাম-চাঁদপুর-লাকসাম (১ সেট)। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট-বুড়িমারী-লালমনিরহাট (২ সেট), লালমনিরহাট-দিনাজপুর-লালমনিরহাট (২ সেট) ও লালমনিরহাট-বগুড়া-লালমনিরহাট (২ সেট)রুটেও এ ট্রেন চালানো হয়। এরমধ্যে ঢাকা-জয়দেবপুরের দূরত্ব ৩৪ কিলোমিটার, ঢাকা-টঙ্গী ২২ কিলোমিটার, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ ৯০ কিলোমিটার, সিলেট-আখাউড়া ১৭৬ কিলোমিটার, ঢাকা-আখাউড়া ১২০ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম-কুমিল্লা ১৫৫ কিলোমিটার,
নোয়াখালী-লাকসাম ৪৮ কিলোমিটার, লাকসাম-চাঁদপুর ৪৯ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট ৩৭ কিলোমিটার, পার্বতীপুর-লালমনিরহাট ৭১ কিলোমিটার এবং পার্বতীপুর-পঞ্চগড়ের দূরত্ব ১৩২ কিলোমিটার। এছাড়া চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয় রুটে এবং দোহাজারী রুটেও দুটি ডেমু চালানো হয়। রেলের প্রকৌশলীরা জানান, রাজনৈতিক বিবেচনায় এক বিভাগীয় শহর থেকে অন্য বিভাগীয় শহরে ডেমু চালানো হয়। এতেই অধিকাংশ ডেমু নষ্ট হয়ে যায়। সংশিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, যাত্রীদের সুবিধার কথা চিন্তা করে ডেমু নামানো হলেও এখন তা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডেমুতে খরচ ক্রমাগত বাড়ছে। রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ৬৬২ কোটি টাকা জলে ফেলে অত্যন্ত নিম্নমানের ডেমু ট্রেন কিনে আনা হয়েছে।
এব্যাপারে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ডেমু চলাচল করছে। বিভিন্ন রুটে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। গতকাল তিন সেট ডেমু মেরামতের জন্য রাখা হয়েছে।
Leave a Reply