রাজধানীতে বাসে আগুনের ঘটনায় বিএনপির জড়িত থাকার ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মাঝপথে নির্বাচন বর্জন করে বাসে আগুন দিয়ে তারা একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়। দেশকে অস্থিতিশীল করতে চায়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘কোনো কথা নাই, বার্তা নাই। হঠাৎ কয়েকটি বাসে আগুন দিয়ে অগ্নিসন্ত্রাস! কেন? কী স্বার্থে? কীসের জন্য? নির্বাচন হয়। (তারা) নির্বাচন করার নামে অংশগ্রহণ করে। টাকা-পয়সা যা পায়, পকেটে রেখে দেয়। নির্বাচনও করে না, এজেন্টও দেয় না, কিছুই করে না। এটার উদ্দেশ্যটা কী?’
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে আনা সাধারণ প্রস্তাবের ওপর গতকাল রোববার আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বিশেষ অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। গত সোমবার সংসদ নেতা শেখ হাসিনা জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাতে ১৪৭ বিধিতে নিজেই এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। গতকাল সংসদে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়।
প্রস্তাবটি গ্রহণের আগে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের সংবিধান গ্রহণের সময় গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনানো হয়। গতকাল প্রধানমন্ত্রীর এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে সংসদের বিশেষ অধিবেশন শেষ হয়। আগামী বুধবার থেকে সংসদের সাধারণ অধিবেশন শুরু হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, শুধু আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় এসে দেশের উন্নয়ন করেছে। বাকিরা ক্ষমতায় এসে দেশের জন্য কিছুই করেনি। জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, তার সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, তার সরকার অনেক দূর কাজ এগিয়েছে, দারিদ্র্যের হার কমিয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বে আগে ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে চললেও এখন আর চলে না। নিজেদের বাজেট নিজেদের অর্থে দিতে পারে। সরকার চ্যালেঞ্জ নিয়েছিল নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করবে, সেটা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ করেছি। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন জাতি গঠন করার পদক্ষেপ আমরা নিয়েছি। স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে, চিকিৎসাসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে। তবে জাতির পিতা যেভাবে চেয়েছিলেন, হয়তো সেভাবে করা যায়নি।
বিভিন্ন মহলের সমালোচনার জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, এর মধ্যে করোনাভাইরাসের কারণে উন্নয়ন কার্যক্রম কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। এটা দুর্ভাগ্যজনক; তারপরও বলব, সেটা সরকার মোকাবিলা করে চলেছে। আজ বাংলাদেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছে, সারাদেশের মানুষ একদিকে করোনা মোকাবিলা করছে। একদিকে করোনা সামলাচ্ছি, আরেক দিকে দেশের অর্থনৈতিক গতিধারা যাতে সচল থাকে, সে ব্যবস্থা নিয়েছি। বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছি। টাকা-পয়সা যেখানে যা দরকার দিয়ে আমরা মানুষের জীবন সচল রেখেছি। ভ্যাকসিন আবিস্কার হচ্ছে। আমরা ভ্যাকসিন কেনার টাকা-পয়সা রেখে দিয়েছি। যখনই চালু হবে, তখনই যেন আমরা পাই। সে ব্যবস্থাটা করে রেখেছি। যখন যা দরকার, সেটা আমরা করে যাচ্ছি। তাহলে অভিযোগটা কোথায়? সেটাই তো বড় প্রশ্ন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই এ জন্য যে, তারা ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। সে জন্যই আমরা দেশসেবার সুযোগ পেয়েছি, সরকার গঠনের সুযোগ পেয়েছি।
ভাষণে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অসামান্য নেতৃত্বের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলায় বঙ্গবন্ধু সরকারের পদক্ষেপগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, জাতির পিতার একটা স্বপ্ন ছিল এই বাংলাদেশকে নিয়ে। সে লক্ষ্য নিয়ে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করেছিলেন। এই স্বাধীনতা একদিনে আসেনি, এর জন্য জাতির পিতা দীর্ঘ সংগ্রাম করেছেন। স্বাধীনতার পর যখন দেশ গঠনে মনোনিবেশ করলেন, তখন দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র শুরু হলো। নানা ধরনের সমালোচনা শুরু হয়েছিল। বলা হলো, তিনি একদলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য।
সংসদ নেতা বলেন, জাতির পিতা বাকশাল গঠন করেছিলেন সবাইকে নিয়ে। তিনি দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। সেই কাজটা করে যেতে পারেননি। জাতির পিতা দেশকে গড়ে তুলতে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। তৃণমূল থেকে দেশের উন্নয়নই ছিল তার লক্ষ্য। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল তার লক্ষ্য। বাংলাদেশের মানুষ সম্মান নিয়ে চলুক, সেটাই জাতির পিতা চেয়েছিলেন। তিনি সমবায়ের মাধ্যমে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ করতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এতে তিন গুণ ফসল বেশি হবে। ৬৫ হাজার গ্রামকে তিনি সমবায়ে নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন। এভাবে তিনি কৃষিকে আধুনিকায়ন করার পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনি প্রশাসনের আমূল পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে এক জায়গায় এনে দেশের উন্নতির জন্য কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন।
তিনি বলেন, জাতির পিতা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘ঘুণে ধরা সিস্টেম দিয়ে দুর্নীতি দূর করা যায় না।’ এ জন্য বঙ্গবন্ধু সিস্টেম পরিবর্তন করে সমাজের সব মানুষকে দুর্নীতিবিরোধী অবস্থানে আনতে চেয়েছিলেন। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে যাতে উন্নতি হয়, সেটাই ছিল জাতির পিতার লক্ষ্য। এ জন্য তিনি পাঁচ বছরের কর্মসূচি নিয়েছিলেন। তিনি যদি সেটা বাস্তবায়ন করতে পারতেন, তবে আজ বাংলাদেশ বিশ্বে উন্নত দেশে হিসেবে থাকত। কিন্তু তাকে সেটা করতে দেওয়া হয়নি।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘মানুষের কাছে যাতে সত্যিকারের গণতন্ত্র পৌঁছে যায়, সে জন্য বঙ্গবন্ধু সে ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থাও তৈরি করেছিলেন। আমি বলব, গণতন্ত্রকে সুসংহত করা, শোষিতের গণতন্ত্র কায়েম করা, ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করে তৃণমূল পর্যায়ে যে ভাগ্য পরিবর্তন হয়, সেটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন। পঁচাত্তরের পরে যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা প্রহসন করে নির্বাচনের সিস্টেমটাই নষ্ট করে দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে একটা সিস্টেমে নিয়ে আসতে, কিন্তু এটা তো হয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু সারাদেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন, চষে বেড়িয়েছেন। এজন্য তিনি সব জানতেন। আর সেটা জানতেন বলেই এদেশের মানুষের ভাগ্যটা কীভাবে পরিবর্তন হয়, সেটার বিষয়ে তিনি যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। এদেশের মানুষের জন্য তিনি কাজ করতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, সে চেষ্টাটাই করেছে। এদেশের মানুষের ভাগ্য কীভাবে পরিবর্তন করা যায়, তার চেষ্টা করেছে।
যেভাবে গৃহীত হলো প্রস্তাবটি : সংসদে গৃহীত প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনার উত্থাপন করা ১৪৭ বিধির সাধারণ প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘সংসদের অভিমত এই যে, ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি, বাঙালির অবিসংবাদিত মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি জাতির অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে তিনি সারা জীবন সংগ্রাম করেছেন। জেল-জুলুম অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন; কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে কখনও আপস করেননি।’
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ‘১৯৫৭-৪৮ থেকে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৬৬-এর ছয় দফা, ১৯৬৮-এর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০-এর নির্বাচন- দীর্ঘ ২৪ বছরের সংগ্রাম ও আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা। ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বজ্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
এতে আরও বলা হয়, ‘বঙ্গবল্পুব্দর ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলার নিরস্ত্র জনগণ ঘরে ঘরে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে দুর্গ গড়ে তুলেছিল। ২৬ মার্চ ১৯৭১-এর প্রথম প্রহরে জাতির পিতা শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এরপর দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লাখ মহান শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান লাভ করে। বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। লাল-সবুজের পতাকা ও সংবিধান।’ প্রধানমন্ত্রী তার প্রস্তাবে বলেন, বঙ্গবন্ধু বিশ্বসভায় বাঙালিকে আত্মপরিচয় নিয়ে গর্বিত জাতিরূপে মাথা উঁচু করে চলার ক্ষেত্র রচনা করেছিলেন।
গত ৯ অক্টোবর সংসদের কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ বিধির আওতায় শেখ হাসিনা এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। নোটিশ আকারে তার প্রস্তাব উত্থাপনের পর এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আলোচনা শেষে গতকাল রাতে প্রস্তাবটি স্পিকার ভোটে দিলে তা কণ্ঠভোটে পাস হয়। এর মাধ্যমে জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করল সংসদ। প্রস্তাবটি পাসের পর স্পিকার বলেন, এর মধ্য দিয়ে বিশেষ অধিবেশন সমাপ্তি হলো। এরপর সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত স্পিকার সংসদের বৈঠক মুলতুবি করেন।
জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত এই বিশেষ অধিবেশন ৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় শুরু হয়। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ইতিহাসে এটাই প্রথম বিশেষ অধিবেশন। আর সংসদ কক্ষে জাতির পিতার ছবিসহ এটাই সংসদের প্রথম অধিবেশন। ৯ নভেম্বর এই প্রস্তাব সংসদে তোলার আগে সংসদে স্মারক বক্তৃতা দেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।
সাধারণ আলোচনার জন্য সংসদ নেতার প্রস্তাব তোলার নজির নিকট অতীতে নেই। সাধারণত জাতীয় সংসদের প্রধান হুইপ বা সংসদের জ্যেষ্ঠ কোনো সদস্য সাধারণ প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকেন। প্রস্তাবটি গ্রহণের আগে গত এক সপ্তাহ প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, বিরোধীদলীয় নেতাসহ সরকারি ও বিরোধীদলীয় ৭৯ সংসদ সদস্য এর ওপর ১৯ ঘণ্টা ৩ মিনিট আলোচনা করেন।
রোববার এই প্রস্তাব গ্রহণের দিন সংসদে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সংসদের ‘প্রেসিডেন্ট’স বক্সে’ বসে সংসদ অধিবেশন দেখেন তিনি। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী রাষ্ট্রপতির উপস্থিতি সংসদ কক্ষে ঘোষণা করেন।
Leave a Reply