প্রায় ২০ মাস বসিয়ে রাখার পর আবারও আকাশে উড়তে চলেছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের ৭৩৭ ম্যাক্স মডেলের উড়োজাহাজ। এতে বলা যায় সুরক্ষা তদারকি এবং অব্যবস্থাপনার কারণে কেবল মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাই নয়, ইতিহাসের ব্যয়বহুল করপোরেট ভুলগুলোর অন্যতম নাম এখন এই বোয়িং ৭৩৭ ম্যাক্স।
২০১৮ সালের অক্টোবরে জাকার্তা বিমানবন্দর থেকে ইন্দোনেশিয়ার লায়ন এয়ারের একটি ফ্লাইট আকাশে ওড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই আছড়ে পড়ে জাভা সাগরে। এর প্রায় ৫ পাঁচ মাস পর ইথিওপিয়ান এয়ারলাইনসের বোয়িংয়ের এই মডেলের একটি উড়োজাহাজ আকাশে উড়েছিল কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির উদ্দেশে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আদ্দিস আবাবা থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে এক শহরের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে। দুই ঘটনাতেই ফ্লাইটে থাকা সব যাত্রীর মৃত্যু হয়। পাঁচ মাসের কম সময়ের মধ্যে দুটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ৩৪৬ জন আরোহী নিহত হওয়ার পর বিশ্বের অধিকাংশ এয়ারলাইনস ও বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ এ উড়োজাহাজ ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
যে প্রত্যক্ষ ক্ষতি বহন করতে হচ্ছে বোয়িংকে এই ২০ মাস ধরে উড়োজাহাজের নিরাপত্তা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে ব্যাপক ব্যয় করতে হয়েছে বোয়িংকে। সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উড়োজাহাজ বসিয়ে রাখায় প্রত্যক্ষ ব্যয় প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে বিমান বসিয়ে রাখায় গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে ৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। উৎপাদনের উল্লেখযোগ্য ব্যয় ৫ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ৭৩৭ ম্যাক্স প্রোগ্রামের ব্যয় বৃদ্ধির জন্য ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়েছে। সংস্থাটি জেট স্টোরেজ, পাইলট প্রশিক্ষণ এবং সফটওয়্যার আপডেটের জন্য প্রায় ৬০ কোটি ডলার ব্যয় করেছে, যা সংস্থার সামগ্রিক ব্যয় অনুমানের অন্তর্ভুক্ত নয়। সেই সঙ্গে ১০ কোটি ডলারের একটি ক্ষতিপূরণ তহবিলও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা বোয়িংয়ের আনুমানিক ব্যয় ২০ বিলিয়ন ডলারের অন্তর্ভুক্ত নয়। অর্থাৎ উড়োজাহাজ বসিয়ে রাখার জন্য বোয়িংয়ের ক্ষতির পরিমাণ ২০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার।
এ ছাড়া বোয়িংয়ের আইনি দায়বদ্ধতা অবশ্যই এই ব্যয় আরও বাড়িয়ে তুলবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত ১১ জন ভুক্তভোগীর পরিবারকে গড়ে ১২ লাখ ডলার দিয়েছে বোয়িং। অর্থাৎ ৫০ কোটি ডলারের মতো। এখানেই শেষ নয়। বোয়িং ব্যয় বহনের জন্য ৫ শতাংশ সুদে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। সংস্থাটি গ্রাউন্ডিংয়ের সময় ৪৫০ ম্যাক্স জেট তৈরি করেছিল, তবে প্রায় দুই বছর এটি একটিও ৭৩৭ ম্যাক্স বিমান বিক্রি করতে পারেনি। আরও নানা হিসাব–নিকাশ মিলিয়ে দেখা যায় শেষমেশ ব্যয় অন্তত ২৫ বিলিয়ন ডলারের গিয়ে ঠেকবে।
এখন পর্যন্ত প্রত্যক্ষ যে ব্যয়ের বিবরণ দেওয়া হলো তাতে ইতিহাসের করপোরেট ভুলের জায়গায় বোয়িংয়ের নাম থাকার কথা নয়। কারণ বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় করপোরেট ভুল হিসেবে ধরা হয় ব্রিটিশ পেট্রলিয়ামের ‘ডিপওয়াটার হরায়জন এক্সপ্লোশন’। ওই ঘটনায় বিপিকে বহন করতে হয় ৬৮ বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি। তবে বোয়িংয়ের প্রত্যক্ষ ক্ষতি সেদিকে না গেলেও দীর্ঘমেয়াদি একটা ক্ষতি বহন করতেই হচ্ছে বোয়িংকে। তাদের বিক্রি ব্যাপক কমেছে। এই দুই বছরে ওই মডেলের যত অর্ডার ছিল সব বাতিল হয়। সেই সঙ্গে করোনা মহামারির কারণে বিমান ভ্রমণের চাহিদা কমেছে। অনেক বিমান সংস্থায় কোনো ক্ষতিপূরণ না দিয়ে চুক্তি বাতিলের সুবিধা নিচ্ছে। এ বছর বোয়িংয়ের ম্যাক্স মডেলের ৪৪৮টি অর্ডার বাতিল করতে হয়েছে। অন্যদিকে অন্য মডেলের উড়োজাহাজ অর্ডার বাতিল হয়েছে ৯টি। স্পষ্টতই ওই দুর্ঘটনার প্রভাবে এই মডেলের অর্ডার বাতিল হয়েছে বেশি। একটি ৭৩৭ ম্যাক্স সাধারণত প্রায় সাড়ে ৫ কোটি ডলারে বা উল্লিখিত দামের অর্ধেকে বিক্রি হয়। সেই হিসাবে বোয়িংয়ের জন্য সবচেয়ে খারাপ হলো বিক্রয় কমে যাওয়ায় বোয়িং আয় হারাবে প্রায় ৬৭ বিলিয়ন ডলার। তাই বলা যায় বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম করপোরেট ভুল হলো বোয়িংয়ের এই ৭৩৭ ম্যাক্স।
Leave a Reply