গত ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২০ পালিত হলো বিশ্ব পর্যটন দিবস। এবারের বিশ্ব পর্যটন দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত ছিল “Tourism and Rural Development” অর্থাৎ “গ্রামীণ উন্নয়নে পর্যটন”। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশে যথাযোগ্যভাবে এ দিবসটি উদযাপন করা হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে জাতিসংঘের অধীনস্ত বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রত্যক্ষ বিষয়তত্তাবধানে সকল সদস্য দেশে দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। দিবসটির প্রধান উদ্দেশ্য হলো- আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও পর্যটন কেন্দ্রের সঙ্গে সেতুবন্ধন গড়ে তোলা এবং পর্যটনের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধিসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক উপযোগিতাকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া । কোনো দেশের যদি সত্যিকার অর্থে উন্নয়ন করতে হয়, তাহলে অবশ্যই গ্রামীণ পর্যায়ের উন্নয়ন সবার আগে দরকার। UNDP এর মতে,“গ্রামীণ উন্নয়ন হল একটি দেশের বা অঞ্চলের বা গ্রামের জনসমষ্টির গড় আয়ু, শিক্ষা ও মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি”। প্রত্যেকটি দেশের শতকরা বেশির ভাগ মানুষের বসবাস গ্রামে। গ্রামীণ উন্নয়নের উপরই একটি দেশের জাতীয় উন্নয়ন নির্ভরশীল। গ্রামই হতে পারে পর্যটন শিল্পের প্রাণকেন্দ্র। গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ, মানুষের সহজ সরল জীবন যাপন পদ্ধতি, উদ্ভিদ, বিভিন্ন পাখি, নদী, হাওড়, বিল, ঝিল, বিভিন্ন ধরণের লোকজ অনুষ্ঠান, গ্রামীণ পেশা, খেলাধুলা, প্রাচীনবৃক্ষ এইসবই হবে পর্যটকদের মনের খোরাক।
বিশের প্রায় সকল দেশেই পর্যটন এখন অন্যতম প্রধান লাভজনক খাত। ১৯৫০ সালে বৈশ্বিক পর্যটকের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৫ মিলিয়ন; যা ২০১৯ সালে এসে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১২৩৫ মিলিয়নে। ধারণা করা হচ্ছে, চলতি বছর প্রায় ১৩৯ কোটি ৫৬ লাখ ৬০ হাজার পর্যটক সারা পৃথিবী ভ্রমণ করবেন। যা বিগত ৬৮ বছরে পর্যটকের সংখ্যার প্রায় ৫০ গুণ। পর্যটকের সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের পরিধি ব্যাপকতা লাভ করেছে।
পর্যটনের মাধ্যমেই অর্থনৈতিক, সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধিত হয়। ২০১৮ সালে বিশ্বের জিডিপিতে ট্যুরিজমের অবদান ছিল ১০.৪ শতাংশ, যা ২০২৭ সালে ১১.৭ শতাংশে গিয়ে পৌঁছাবে। এছাড়া ২০১৮ সালে পর্যটকদের ভ্রমণখাতে ব্যয় হয়েছে ১৮৯৪.২ বিলিয়ন ডলার। আর একই বছর পর্যটনে বিনিয়োগ হয়েছে ৮৮২.৪ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সালে আমাদের দেশে জিডিপি খাতে পর্যটন শিল্পের অবদান ছিল ৮৫০.৭ বিলিয়ন টাকা। এ খাতে কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে ২৪ লাখ ৩২ হাজার। একই বছর পর্যটন খাতে বিনিয়োগ এসেছে ৪৩ বিলিয়ন টাকা। তাছাড়া ধারণা করা হয়, গত বছর বাংলাদেশে প্রায় ৫ লাখ বিদেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন।
যা খুবই আশাব্যঞ্জক ও জাতীয় অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক।পর্যটন শিল্পের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী ১৩ কোটিরও বেশি মানুষ সরাসরি জড়িয়ে রয়েছেন। ২০১০ সালে বিশ্বব্যাপী ভ্রমণ করেছেন ৯০ কোটি লোক। এ শিল্প থেকে আয় হয়েছে ৫০ হাজার কোটিরও বেশি মার্কিন ডলার। ২০১৯ সালে পর্যটন বাংলাদেশের জিডিপিতে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থাৎ ৭৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকার অবদান রেখেছে, পর্যটন রপ্তানির মাধ্যমে একই বছর ২ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সমমানের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে এবং এই সেক্টরে বর্তমানে নিয়োজিত আছে প্রায় ৪০ লাখ কর্মী। এই কর্মীদের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ। পর্যটনের অপার সম্ভাবনায় বাংলাদেশ। এখন প্রতিবছর প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ লাখ পর্যটক দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে ভ্রমণ করে থাকেন।পর্যটন শিল্পের ব্যাপকতার অন্যতম এর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নিহিত রয়েছে। সেই দিক থেকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরো গতিশীল করতে ও ব্যাপক কর্মসংস্থান তৈরিতে এই শিল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বর্তমানে পৃথিবীর ৪টি কর্মসংস্থানের মধ্যে ১টি কর্মসংস্থান তৈরি হয় পর্যটন খাতে। বর্তমানে বাংলাদেশের পর্যটন খাতে আয় প্রায় ৭৬.১৯ মিলিয়ন ডলার। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার প্রাক্কলন অনুযায়ী ২০২০ সাল নাগাদ পর্যটন শিল্প থেকে প্রতি বছর ২ ট্রিলিয়ন ডলার আয় হবে। ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৫১টি দেশের পর্যটকরা বাংলাদেশে ভ্রমণ করবে, যা মোট জিডিপির ১০ শতাংশ অবদান রাখবে। ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিলের (ডব্লিউটিটিসি) তথ্যানুযায়ী, বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের অবদান ৮ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৯ সালে পর্যটন শিল্প বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ২ দশমিক ৯ ট্রিলিয়ন ডলার অবদান রাখে, যা বিশ্ব জিডিপির ১০ দশমিক ৩ শতাংশ ।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে ১৫৬ কোটি পর্যটক, অর্থাৎ প্রতি ৭ জনের একজন পর্যটক। জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ফলে সাধারণ মানুষের কাছে ভ্রমণপিপাসা অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে বিধায় আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টিতে অনন্য অবদান রাখছে। বাংলাদেশে পর্যটন খাতে সরাসরি কর্মরত আছেন প্রায় ১৫ লাখ মানুষ। এ ছাড়া পরোক্ষভাবে ২৩ লাখ। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৪০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১১০ কোটি। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ২০০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে।
আর বিপুলসংখ্যক পর্যটকের প্রায় ৭৫ শতাংশ ভ্রমণ করবেন এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশ যদি এ বিশাল বাজারে টিকে থাকতে পারে, তাহলে পর্যটনের হাত ধরেই বদলে যেতে পারে দেশের অর্থনীতির রূপরেখা। বাংলাদেশ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে শোভাময় এক লীলাভূমি। এই দেশের প্রতিটি পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে অপার সৌন্দর্যের সমাহার।
আমাদের দেশের গ্রামগুলো ছবির মতো সাজানো আর গ্রামের সহজ সরল মানুষগুলোর অতিথিপরায়ণতা গ্রামীণ সৌন্দর্যকে হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়। অন্ধকার রাতে জোনাকি পোকার শরীরের আলো গ্রামগুলোকে করে তোলে চোখ ঝাঁঝালো। গ্রীষ্মকালে প্রতিটি গ্রামে গাছে গাছে আম, কাঠাল, লিচুতে ভরপুর থাকে। নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় গ্রামগুলোতে শুরু হয় নবান্ন অনুষ্ঠান উদযাপনের আমেজ।
বাংলাদেশের গ্রামগুলো হতে পারে পর্যটন আকর্ষণের অপার সম্ভাবনা। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন ১৯৯০ সালে ‘ওয়ান ভিলেজ ওয়ান ডেস্টিনেশন’ নামে প্রচারাভিযান করেছিল। সেই প্রচারাভিযানের আলো্কে ‘একটি গ্রাম একটি পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে আমরা বিদেশি পর্যটকদের কাছে আমাদের গ্রামগুলকে উপস্থাপন করতে পারি ।বাংলাদেশের ৮৬ হাজার গ্রামবাংলা ৮৬ হাজার পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র কারণ একটি গ্রাম থেকে আরেকটি গ্রাম আলাদা। কোন কোন গ্রাম নদীকেন্দ্রিক, পাহাড় কেন্দ্রিক, হাওরকেন্দ্রিক, বিলকেন্দ্রিক।
একটি গ্রাম থেকে আরেকটি গ্রামের মানুষের আচার-ব্যবহার, সংস্কৃতি, শিক্ষাদীক্ষা, প্রথা, নীতি, জীবনযাত্রা, বিবাহ-অনুষ্ঠান আলাদা।কৃষকের ধানের চারা রোপণের দৃশ্য আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেয় এই দৃশ্য পৃথিবীর অন্য কোথও দেখা পাওয়া বিরল।মাঠের পর মাঠ সবুজ শস্যক্ষেত্গুলো দেখে যেন মনে হয় সবুজ রাজ্য হাতছানি দিয়ে ডাকছে।গ্রামীণ মানুষের অতিথিপরায়ণতা যে কোন পর্যটককে বার বার ফিরে নিয়ে আসবে গ্রামগুলো ভ্রমণ করতে। যদি গ্রামীণ পর্যটনের দিকে গুরুত্ব দিয়ে গ্রামীন পর্যটনকে বিকশিত করতে পারি তাহলে গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, গ্রামীণ শিক্ষিত বেকারদের কাজের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা যাবে। গ্রামীণ পর্যটনের জন্য আমাদের বেশি কিছু করতে হবে না কারণ বিদেশী পর্যটকেরা গ্রামীণ পরিবেশ বেশি উপভোগ করে। তাদের জন্য নতুন করে ইটের ঘর-বাড়ি বানানোর দরকার নেই। এক্ষেত্রে আমরা হোম-স্টে বাবস্থা করতে পারি, যেখানে পর্যটকদের নিজের পরিবারে এর সদস্য হিসাবে আপ্যায়ন করা হবে ।
বিদেশী পর্যটকরা গ্রামে যায় গ্রামীণ সৌন্দর্য অবলোকন করতে, সেখানকার মানুষের সাথে মিশে তাদের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা, খাদ্য-অভ্যাস সম্বন্ধে জানতে। তারা আমাদের সাথে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী খাবার খাবে, কৃষকদের ফসল রোপণ করা দেখবে, পুকুর থেকে মাছ ধরবে, পাকা ফল গাছ থেকে পেড়ে খাবে এবং যেসব এলাকায় মাটির ঘর-বাড়ি সেখানে মাটির ঘর-বাড়িতে তারা রাতে ঘুমাবে এগুলো হবে তাদের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা।কারণ পর্যটকরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে এবং এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে যায় অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করতে জনগোষ্ঠির সহায়তায় পর্যটন পণ্যের সংরক্ষণ ও পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
আকর্ষণীয় স্থানসমূহের সংস্কৃতিকর্মীদের সমন্বয়ে স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করে স্থানীয়ভাবে কমিটি গঠন এবং আগত দেশী-বিদেশী পর্যটকদের বিনোদনের লক্ষ্যে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানাদি আয়োজনের জন্য উৎসাহিতকরণ। বিদেশী পর্যটকদের জন্য ‘কমিউনিটি হোম-স্টে’ এর ব্যবস্থা গ্রহণ করে স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীদের কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানসমূহকে কমিউনিটি পর্যটন উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনায় সম্পৃক্তকরণ। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠির মধ্য থেকে তরুন তরুণদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন ভাষায় ট্যুর গাইড তৈরীর লক্ষ্যে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় স্বল্প, মধ্য, দীর্ঘ মেয়াদী বিভিন্ন পর্যটন প্রকল্প গ্রহণ।
গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবস্থাকে চাঙ্গা করা ও গ্রামীণ কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণের চেয়েও বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বাংলাদেশের গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন। গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের আর্থিক সচ্ছলতাসহ এদের স্থায়ী উপার্জনের পথ সুগম হয়। এর জন্য ছোট ছোট পর্যটন উদ্যোক্তাদের সহজ শর্তে সরকারিভাবে ঋণও দেওয়া যেতে পারে।
গ্রামাঞ্চলে বিনোদন সেবা প্রদানে পর্যটন উন্নয়ন করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রতিটি গ্রামকে আমাদের বানাতে হবে একেকটি পর্যটন গন্তব্য বা ডেস্টিনেশন। এসব গন্তব্যে শহরের পর্যটকরাও বেড়াতে যাবে, যাতে করে গ্রাম এলাকায় আর্থিক কর্মকাণ্ডসহ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। এজন্য প্রয়োজন প্রতিটি গ্রামে বিনোদন পার্ক, শিশুপার্ক এবং ঐতিহ্যবাহী স্পোর্টস আয়োজনের জন্য পর্যাপ্ত মাঠ। এগুলোর দ্রুত বাস্তবায়ন দ্রুত ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে আশা করা যায়। গ্রামীণ পর্যটনের উন্নয়ন হলে পণ্যের বৈচিত্র্যকরণ এবং অনেক ধরনের ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তা সৃষ্টি হবে। যেমন- চিড়া-মুড়ি-খই-দই প্রস্তুতকারক ও বিক্রেতা, পিঠা-পায়েস-মোয়া প্রস্তুতকারক, হস্তশিল্প (বাঁশ, বেত, হোগলা) প্রস্তুত ও বিপণনকারী ইত্যাদি। এদের টিকিয়ে রাখার জন্য সহজ শর্তে সরকারি ঋণের প্রয়োজন। গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে হবে। এজন্য আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যগুলোকে নান্দনিক উপায়ে তুলে ধরতে হবে। আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্যগুলো হচ্ছে গ্রাম্য সমাজব্যবস্থা, কৃষি জমির চিরায়ত পদ্ধতিতে চাষাবাদ, চিরায়ত লোকসংগীত, দেশীয় খাবার প্রস্তুতি- চিড়া, মুড়ি, খৈ, খেজুরের পায়েস, মাডা, ইত্যাদি।
এগুলোই পর্যটকরা দেখতে চায়, উপভোগ করতে চায়। এসব পণ্য প্রসারের লক্ষ্যে এবং তা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার জন্য সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। বর্তমানে অনেক প্রাইভেট ট্যুর অপারেটর গ্রামীণ জীবনযাপন পর্যটকদের দেখানোর জন্য গ্রামে নিয়ে যায়। এতে গ্রামীণ জনগণের তেমন উপকার হয় না। গ্রামীণ জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহন প্রয়োজন।তাছারাও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মত আমরা পর্যটন গ্রাম তৈরি করতে পারি। যেখানে পর্যটকদের জন্য হোম- ষ্টে বেবস্থা করা যেতে পারে। দেশে গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নে পর্যটনকে কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে- ফার্মিং ট্যুরিজম, ইকো-ট্যুরিজম, গ্রিন ট্যুরিজম ইত্যাদি। ফার্মিং ট্যুরিজমের মধ্যে গ্রামবাংলার স্বকীয় কৃষি খামার ও জমির চাষাবাদ পদ্ধতি, ফসল কাটার দৃশ্য, সেচ প্রণালী, ফসল তোলা, গ্রামীণ মহিলাদের ধান শুকানো, ধান উড়ানো এবং ধান ভানার দৃশ্য হতে পারে অন্যতম আকর্ষণ। এছাড়াও ইকো-ট্যুরিজম হতে পারে গ্রামবাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্যবলী, নদী-নালা, খাল- বিল এবং দেশীয় মাছ, পশু, পাখিসহ নানা প্রজাতির জৈববৈচিত্র্য। গ্রামীণ ট্যুরিজমের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গ্রিন ট্যুরিজম। অনেক বিদেশি বাংলাদেশের অবারিত সবুজের সমারোহ দেখে মুগ্ধ হয়ে যায়। গ্রিন ট্যুরিজমের সব উপাদানই বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যমান।
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত ও শীত- সব ঋতুতে বাংলাদেশ সবুজে আচ্ছাদিত থাকে। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে প্রাথমিকভাবে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলোসহ ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, হালুয়াঘাট, সিলেট এবং সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন করা যেতে পারে। উল্লেখিত এসব জেলায় এমনিতেই যথেষ্ট পর্যটন উন্নয়ন ও বিকাশের সম্ভাবনা রয়েছে। দেশের গ্রামাঞ্চলে পর্যটন উন্নয়নের সঙ্গে পরিবেশ পরিকল্পনা অবশ্যই পাশাপাশি থাকবে। পরিবেশকে ক্ষতি করে যেমন গ্রামীণ পর্যটন হবে না, আবার শুধু পরিবেশ রক্ষার দোহাই দিলেও পর্যটনের উন্নয়ন হবে না। বিষয়টি পরিপূরক।একে মূলত রেসপন্সিবল ট্যুরিজম বলা হয়।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করাসহ গ্রামকে শহরে রূপান্তরের জন্য গ্রামীণ বিনোদন তথা গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়ন একান্ত প্রয়োজন।যেহেতু বাংলাদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ কম, সেজন্য পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন ঘটলে বাংলাদেশের মানুষের, বিশেষ করে গ্রামীণ মানুষের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে। এর জন্য গ্রামের যুবসমাজকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ- গাইডিং, কুকিং, ইন্টারপ্রিটেশনসহ নানা প্রশিক্ষণ। সরকার গ্রামীণ পর্যটন উন্নয়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য দূরীকরণের দিকে যথাযথ নজর দিলে ২০৩০ সাল নাগাদ সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জন করতে পারে।
বর্তমান বিশ্বে পর্যটন একটি লাভজনক এবং অপেক্ষাকৃত কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং বহুমুখী কর্মসংস্থান সহায়ক বড় শিল্পখাত। বিশ্ববাণিজ্যের ক্ষেত্রে অবদান রাখছে শতকরা ৬ ভাগ যার পরিমাণ ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার। জানা গেছে, ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা প্রতিবছর থাকা, খাওয়া, ভ্রমণ, দর্শন এবং কেনাকাটা বাবদ খরচ করেন প্রায় ৫০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আরও জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৮৩ ভাগ দেশের সবচেয়ে জাতীয় আয় আহরণকারী প্রথম পাঁচটি খাতের মধ্যে পর্যটন একটি বিশেষ খাত। পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পর্যটকরা এখন পুরাকীর্তি, বাগান, পাহাড়, সাগর, ঝরনার পাশাপাশি ইকো ট্যুরিজমের দিকে ঝুঁকছে। প্রকৃতির পাশাপাশি মানুষের বিচিত্র জীবনধারা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিও পর্যটকদের আকর্ষণ বাড়ছে।
পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পরিকল্পনা। এই শিল্পের সাথে সম্পৃক্ত সকল পক্ষকে নিয়ে একসাথে কাজ করে যেতে হবে। দেশীয় পর্যটন বিকাশের পাশাপাশি বিদেশী পর্যটক আকর্ষনে প্রচার প্রচারনার উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। পাশাপাশি এই শিল্পের উন্নয়নের সাথে সাথে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরীর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। সঠিক কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে পর্যটন শিল্প অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারবে। অপরূপ বাংলাদেশটাকেও বিশ্বমানুষ তাদের অবকাশযাপনের ঠিকানা হিসেবে ভাববে, যদি আমরা মেধাবী ও যোগ্য মানুষদের ঠিক জায়গায় বসাতে পারি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে সুপরিচিত বাংলাদেশে রয়েছে একাধিক পর্যটন কেন্দ্র।
এছাড়া রয়েছে সম্ভাবনাময় আরো বহু পর্যটনবিধৌত স্থান। সময়োপযোগী ও পরিকল্পনামাফিক পদক্ষেপ গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে এসব পর্যটন স্পট যদি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলা যায়, তাহলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পে নবদিগন্তের সূচনা হবে। তবে পর্যটন বলতে শুধু ঘোরাফেরার ধারণা পরিবর্তন করে একে বহুমুখী করার প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। যাতে এই দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধিত হয়। তবেই অপরূপ বাংলাদেশটাকেও বিশ্ব মানুষ তাদের অবকাশ যাপনের ঠিকানা হিসাবে চিন্তা করবে।
প্রফেসর ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, চেয়ারম্যান,
ট্যুরিজম এন্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ।
Leave a Reply