যুদ্ধ দিনের স্মৃতি
‘করিমকো নিকালো, হারামজাদা কাঁহা হ্যাঁয়”। পাক সেনারা ঠিক এভাবেই বাবার নাম ধরে তাঁকে খুজছিলো। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর এক মাস পর ঢাকার পয়গাম পত্রিকা অফিসে পাক সেনারা চড়াও হয়। ভাগ্যিস সেই সময়ে তিনি অফিসে ছিলেন না। এমন কিছু একটা হবে টের পেয়ে দুপুরের আগেই তিনি অফিস ছেড়েছিলেন। নইলে কী হতো সেদিন, সেটা অনুমান করা যায়। তারা বাবাকে না পেয়ে অফিসে কর্মরত সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানসহ অন্যান্য সংবাদ কর্মীকে বেধড়ক মারধোর করে। তারা পেটাচ্ছিলো আর বলছিলো, ‘করিমকো নিকালো, হারামজাদা কাঁহা হ্যাঁয়”।
‘প্রবীন সাংবাদিকদের আত্মকথা’ নামের একটি বইয়ে সাংবাদিক এম এ করিম বলেছেন, ‘‘পয়গামের সম্পাদক তখন মুজীবুর রহমান খাঁ। বার্তা সম্পাদক ছিলেন আসাদুজ্জামান বাচ্চু। আমানুল্লাহ কবির, জহিরুল হক পয়গামেই কাজ করছিলেন। ‘৭১ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝি দেশের অবস্থা খুবই নাজুক ও পাক বাহিনী বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্ন হামলা ও হত্যাকান্ড চালাচ্ছে। এমনি একদিন সকালের পালায় আমি পয়গামে ডিউটি করছিলাম। হঠাৎ মোনায়েম খাঁর ছেলে মো. কামরুজ্জামান খসরু আমাকে তাঁর চেম্বারে ডেকে নিয়ে বললেন, করিম সাহেব, আপনার আর অফিসে আসা ঠিক হবে না। এখনই চলে যান। সেনাবাহিনীর কালো তালিকায় প্রায় ৪০ জন সাংবাদিকের নাম রয়েছে। তাতে আপনার নামও তালিকাভুক্ত। এই বলেই তিনি একাউন্ট্যান্ট তারিনী শংকরকে ডেকে নির্দেশ দিলেন আমার হিসেব নিকেশ করে পাওনা-দেনা বুঝে দিতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই আমার পাওনা-দেনা বুঝে পেলাম। খসরু ভাই আবারও আমাকে বললেন, আমি কোথায় যাব, সেখানে তিনি আমাকে পৌঁছে দেবেন। ভবিষ্যতে যেখানে যে অবস্থায় থাকি না কেন, টাকা-পয়সার প্রয়োজন হলে আমি যেন তাকে স্মরণ করি। পরক্ষণেই আমার ইচ্ছা অনুযায়ী তিনি ফার্মগেট এলাকায় আমাকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। পয়গামের ফটোগ্রাফার ছিলো তখন মানু মুন্সী। পরদিন সকালে কোনো এক যায়গায় তার সঙ্গে আমার দেখা হলে তার মুখেই শুনলাম, সেদিন রাতেই নাকি সেনাবাহিনীর লোকজন পয়গাম অফিস ঘেরাও করেছিলো এবং আমাকে হন্যে হয়ে খুঁজেছে। আমাকে না পেয়ে নিউজ টেবিলে উপস্থিত সাব-এডিটর ও শিফট ইনচার্জ নাজিমুদ্দিন মাস্তানকে বেদম মারধর করেছে। প্রেস সেকশনে গিয়েও ইনচার্জ ইসমাইল ও আরো অনেককে পিটিয়েছে। সেনা সদস্যদের ছিলো একটি কথা, ‘‘করিমকো নিকালো, হারামজাদা কাঁহা হ্যাঁয়।” (পৃষ্ঠা নং ১২৯)
প্রয়াত সাংবাদিক মীর নূরুল ইসলাম সম্পাদিত এই বইয়ের আরেক জায়গায় হুলিয়া জারি নিয়ে বলেছেন, ‘‘১৯৬২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী। ঢাকার অধিকাংশ খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের একটি নির্দেশনামা প্রকাশিত হয়। এই নির্দেশনামাটি ছিল একটি গ্রেফতারী পরোয়ানা। এতে তিনজনের নাম ছিলো। এরা হলেন আব্দুল জব্বার খদ্দর, আজাদ সুলতান ও এম এ করিম। আগামী ৭ দিনের মধ্যে ডিসি’র কাছে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। অন্যথায় এদের নামে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে বলে এই নির্দেশনামায় উল্লেখ করা হয়েছিলো। ডিসি’র এই নির্দেশনামা সকাল বেলা চায়ের টেবিলে প্রথম খবরের কাগজ পড়তে পড়তে আমার চোখে পড়ে। দেখে মনে মনে একটু হাসলাম, আর ভাবলাম বেশ ভালোই হয়েছে। এতদিনে সরকারের কাছে একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে স্বীকৃতি পেলাম। তখন আমি জগন্নাথ কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ………………..। সাত দিনের সময়সীমা চলে যাওয়ার পর আঁচ করতে পারছিলাম স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকজন সক্রিয় হয়ে উঠেছে। আমাকে খুঁজাখুজি শুরু করেছে। বাসা অফিস এমনকি আমার জগন্নাথ কলেজ পর্যন্ত। পরিচিতজনেরা আমাকে সতর্ক করে দিলো। গ্রেফতার এড়াতে এখানে সেখানে বন্ধু বান্ধবের বাসা বাড়িতে পালিয়ে বেড়াতে লাগলাম। …….রমজান মাস চলছে। ১২ মার্চ ছিলো ঈদুল ফিতর। (আমি তখন পুরানা ঢাকার ১৮ নং কারকুনবাড়ি লেনে চাচাতো বোনের বাসায় থাকি। ভগ্নিপতি তৎকালীন সময়ে দৈনিক আজাদের সহকারি সম্পাদক ও জাতীয় প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মুজীবুর রহমান খাঁ)। ১০ মার্চ সকালে আমি কাপড়-চোপড় নেওয়ার জন্যে বাসায় এসেছি। সন্ধাতে একটু আধার নামলেই চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু জরূরি এক প্রয়োজনে বাসার কাছেই যাওয়ার জন্যে বের হতে হলো। বাসা থেকে বের হলাম ঠিকই, তবে বাসায় ফেরা হলো না। নীচ তলায় আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলো স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোকজন। আমি নীচ তলায় নেমে গেট থেকে বেরিয়ে দু’পা এগিয়ে যেতেই ঘিরে ফেললো তারা। কোনো কথা বলার সুযোগ পেলাম না। সেখান থেকে সোজা নিয়ে গেলো লালবাগ থানায়। পরদিন বিকালে পাঠিয়ে দেওয়া হলো ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। জেলগেট থেকে ২৬ নাম্বার সেল। জেলখানায় থেকেই সেসময়ে আমাকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে হয়েছিলো। (পৃষ্ঠা ১২৫ ও ১২৬)
বাবা, তুমি তোমরা ছিলে বলেই আজ স্বাধীন বাংলাদেশ। তোমাদের অবদান অবশ্যই জাতি মনে রাখবে। তোমায় স্যালুট! ফেসবুক থেকে।
Leave a Reply