বিশ্বের মধ্যে অন্যতম জনবহুল দেশের একটি বাংলাদেশ। দেশটির স্থলভাগের সম্পদ ক্রমশ হ্রাস পাওয়ার পাশাপাশি কমছে জমির পরিমাণ। সঙ্গত কারণেই নতুন সম্পদের খোঁজ করা এখন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রসীমার বিরোধ মীমাংসা হওয়ায় আমাদের সমুদ্রসীমায় সম্পদ আহরণের বিষয়টি বারবার আলোচনায় এসেছে। অবশ্য বাংলাদেশ ব-দ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান-২১০০ মহাপরিকল্পনায় সমুদ্র অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয়, স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে গেলেও সমুদ্রসম্পদের সদ্ব্যবহারে বাংলাদেশ এখনো আশানুরূপ সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। সে তুলনায় প্রতিবেশী দেশগুলো অনেকটাই এগিয়ে।
বিশ্বের মোট বাণিজ্যের ৮০ শতাংশই হয়। ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, এশিয়ার পরাশক্তি চীন স্থলপথে বাণিজ্য বাড়াতে ওয়ান বেল্ট রোড তথা সিল্ক রোড বানাচ্ছে। ঠিক তেমনি সমুদ্র পথেও বঙ্গোপসাগর এলাকা দিয়ে ইউরোপের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে তত্পর চীন। আরেক পরাশক্তি ভারতও বসে নেই। ফলে আমাদের অঞ্চলটির কৌশলগত গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশ এ সুযোগটি কাজে লাগাতে পারে। এ অঞ্চলে আমাদের প্রতিবেশী স্থলবেষ্টিত দেশ হলো নেপাল ও ভুটান। বাণিজ্যিক পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে আকাশ কিংবা স্থলপথের তুলনায় জলপথে খরচ খুবই কম। তাই তারা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করতে চাইলে বন্দর সুবিধা দিতে পারে বাংলাদেশ। চলতি মাসের ৬ তারিখ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য সম্প্রসারণে বাংলাদেশ ও ভুটানের মধ্যে অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তির স্বাক্ষর সেটারই বার্তা বহন করছে।
অভ্যন্তরীণ মত্স্য উত্পাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ঈর্ষণীয়। প্রতি বছর আমরা স্বাদু পানির মত্স্য রপ্তানি করছি। তবে সারা বিশ্বে স্বাদু পানির মাছের তুলনায় সামুদ্রিক মাছের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা দুই-ই বেশি। এদিক দিয়ে সফল হলে মাছ রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। সেই সঙ্গে নিজেদের মোট দেশজ উত্পাদন বৃদ্ধি ও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ তো রয়েছেই। গবেষকদের মতে, সামুদ্রিক সম্পদ সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে বাংলাদেশের পক্ষে প্রতি বছর প্রায় ২৫০ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।
সমুদ্রের বিস্তৃত জলরাশি এবং তার তলদেশের অফুরন্ত প্রাকৃতিক সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের জন্য প্রস্তুতিটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সামুদ্রিক সম্পদগুলোর অস্তিত্ব সাধারণত ১ হাজার ৪০০ মিটার থেকে ৩ হাজার ৭০০ মিটারের ভেতর থাকে। এই সম্পদ আহরণ করা অত্যন্ত টেকনিক্যাল একটি বিষয়। সেজন্য প্রয়োজন দক্ষ জনবল। আমাদের বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের যে মালিকানা পেয়েছে, সেখানে চারটি ক্ষেত্রে কার্যক্রম চালানো হলে পুরোপুরি সফলতা পাওয়া সম্ভব। এই চারটি ক্ষেত্র হলো—তেল-গ্যাস উত্তোলন, মত্স্য সম্পদ আহরণ, বন্দরের সুবিধা সম্প্রসারণ ও পর্যটন।
বঙ্গোপসাগরে উল্লেখযোগ্য প্রাণিজ সম্পদগুলো হলো—৪৭৫ প্রজাতির মাছ, ৩৩৬ প্রজাতির চিংড়ি, ৩ প্রজাতির লবস্টার, ৩ প্রজাতির তিমি, ১০ প্রজাতির ডলফিন ও ২০০ প্রজাতির শৈবাল। সম্প্রতি সামুদ্রিক শৈবাল (সুপার ফুড বলে খ্যাত) অনেক দেশেই জনপ্রিয়তা কুড়িয়েছে। এই শৈবাল বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনাময় রপ্তানির ক্ষেত্র হতে পারে। আজকাল ওষুধ তৈরিতেও এটি ব্যবহূত হচ্ছে। আবার বাংলাদেশের আওতাভুক্ত অঞ্চলে ১৭ ধরনের মূল্যবান খনিজের সন্ধান পাওয়া যায়। এর মধ্যে মোনাজাইট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্র সৈকতের বালিতে এটির মজুত ৪৪ লাখ টন আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরের ১৩টি স্থানে পাওয়া গেছে।
উপকূলীয় অঞ্চলের পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের জীবন-জীবিকা সমুদ্রসম্পদের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের ট্রলারগুলো উপকূল থেকে ৭০ কিলোমিটারের বেশি গভীরে মাছ ধরতে পারে না। আবার এর বাইরে ৬০০ কিলোমিটার বেশি সমুদ্র অঞ্চলে আমাদের মাছ ধরার আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে।
সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের লক্ষ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। যেমন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসম্পদ আহরণের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের বিনিময় ঘটিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। এতে করে সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে বাংলাদেশের জন্য সুফল বয়ে আনবে।
এশিয়ার উদীয়মান শক্তি বাংলাদেশ ২০১৮ সালে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশকে ২০২৪ সালে উন্নয়নশীল ও ২০৪১ সালে একটি উন্নত দেশে রূপান্তরের যে স্বপ্ন আমরা দেখছি, ব্লু-ইকোনমির সদ্ব্যবহারই সেটি বাস্তবায়নের অগ্রযাত্রাকে আরো গতিশীল করে তুলবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
Leave a Reply