মার্কো পোলোর আসল নাম আলেক্সান্ডার পুশকিন। ১৯৬৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বাল্টিক শিপিং কোম্পানি জাহাজটি পূর্ব জার্মানিতে সমুদ্রগামী লাইনার হিসেবে তৈরী করে। ২০ হাজার টন ধারণক্ষমতার লাইনারে ৭৫০ জন যাত্রী ভ্রমণ করতে পারতেন। বাল্টিক শিপিং কোম্পানির পক্ষে কাজ করে জাহাজটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্য পশ্চিমা মুদ্রা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো সেসময়। বড় ধরনের পরিবর্তন এবং সংযোজনের পরে জাহাজটি ১৯৯৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নাম বদলে মার্কো পোলো হিসেবে ওরিয়েন্ট লাইনের মালিকানায় সমুদ্রে চলাচল করে। জাহাজটি সম্প্রতি যুক্তরাজ্য ভিত্তিক ক্রুজ ও মেরিটাইম ভয়েজেস এবং এর জার্মান সহায়ক সংস্থা ট্রান্সসোইন ট্যুরের হয়ে কাজ করছিল। কভিড-১৯ মহামারীর কারণে ২০২০ সালে ক্রুজ ও মেরিটাইম ভয়েজেস কর্তৃপক্ষ সিডাব্লু কেলক অ্যান্ড কোং লিমিটেডের মাধ্যমে এক নিলামে ২৭ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলারে (প্রায় সাড়ে ২৩ কোটি টাকা) বিক্রি করে দেয়।
১৯৬৬ সালে জাহাজটি ট্রান্স-আটলান্টিক সার্ভিস শুরু করে। পুরনো পথ ধরে যাত্রীবহনকারী শেষ লাইনার বলা যায় মার্কো পোলোকে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ায় শিগগিরি জাহাজটিকে রুট পরিবর্তন করতে হয়। লেনিনগ্রাড-মন্ট্রিল চলাচল শুরু করে মার্কো পোলো। আটলান্টিক অতিক্রম করার সবচেয়ে সাশ্রয়ী উপায় হয়ে উঠে এই জাহাজ। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ইউরোপীয়া চ্যানেলগুলিতে গমনেরও অন্যতম মাধ্যম হয় মার্কো পোলো। এ কারণে ইউরোপজুড়ে যাত্রীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠে জাহাজটি। তবে জাহাজটির সেবা ছিল সাময়িক সময়ের জন্য। গ্রীষ্মেই বেশিরভাগ যাত্রী বহন করতো। বছরের বাকিটা সময় সরকারী কাজেই নিয়োজিত থাকতো। ধারণা করা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা জাহাজ হিসেবে ব্যবহৃত হতো মার্কো পোলো (আলেক্সান্ডার পুশকিন)।
গ্রীস্মকালে বেশিরভাগ শিপিং লাইন আটলান্টিকে যাত্রী পরিবহন বাতিল করলেও সেসময় আলেকজান্ডার পুশকিন সেবা অব্যাহত রাখতো। ১৯৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে আটলান্টিকে একটি নতুন নির্মিত জাহাজ মিখাইল লের্মোনটোভের সাথে যোগ দেয়। তবে ১৯৭০ এর দশকের শেষদিকে সোভিয়েতরাও আটলান্টিকে যাত্রী পরিবহন সেবা কমিয়ে দেয়। আলেকজান্ডার পুশকিন অবশ্য ক্রুজ জাহাজ হিসাবে যাত্রা চালিয়ে যাচ্ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর্যন্ত প্রায়ই পশ্চিমা সংস্থাগুলির হয়ে কাজ করতো। মাঝে মধ্যে রাষ্ট্রীয় কাজেও নিয়োজিত থাকতো।
১৯৯০ সালে হোটেল উদ্যোক্তা গেরি হেরোড জাহাজটি কিনে নেন। তিনিই জাহাজটিকে একটি ডিলাক্স ক্রুজ শিপে রূপান্তর করেন। গ্রীসের শিপইয়ার্ডে পুন:নির্মাণের কাজ করা হয়। পশ্চিমা স্ট্যান্ডার্ডে আধুনিকীকরণ করতে প্রায় তিন বছর সময় লেগেছে। যাত্রীদের বসবাসের জন্য আধুনিক আসবাব বসানো হয়। এছাড়া ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পুরো সিস্টেমই সময়োপযোগী করা হয়।
১৯৯৩ সালে হেরোড তার নতুন ক্রুজ লাইনটি ওরিয়েন্ট লাইন নামে চালু করেন। বর্তমানে মার্কো পোলো নামে জাহাজটি ইউরোপে দীর্ঘ সমুদ্রভ্রমণে নিয়ে যেতো যাত্রীদের। সোভিয়েত যুগের শক্তিশালী হোলকে কাজে লাগিয়ে সমুদ্র যাত্রায় মার্কো পোলো অন্যদের চেয়ে অগ্রণী ছিল। পাঁচ বছর পরে হেরোড ওরিয়েন্ট লাইন নরওয়েজিয়ান ক্রুজ লাইনের কাছে বিক্রি করে দেন। নতুন কোম্পানি জাহাজটি চালাতে থাকে।
মার্কো পোলোকে গ্লোবাল মেরিটাইম গ্রুপের কাছে বিক্রি করা হয়। ২০০৮ সালে ট্রান্সওশেন ট্যুর কোম্পানি মার্কো পোলোকে পরিচালনা করে। দুই বছর পরে, ইউকে-ভিত্তিক একটি সংস্থা ক্রুজ এবং মেরিটাইম ভয়েজেস জাহাজটি নিয়ে নেয়। এরপর থেকে এই কোম্পানির অধীনেই ছিল মার্কো পোলো। ছোট আকার এবং ঐতিহ্যের চিহ্ন বহন করায় অনেক বিত্তশালী যাত্রীর কাছে মার্কো পোলোর বিশেষ কদর ছিল ।
২০১৫ সালে, জাহাজটি পঞ্চাশতম বার্ষিকী উদযাপন করে। সেসময়ই সিএমভি জানায় ধীরে ধীরে ক্যারিয়ারের শেষ সময় অতিক্রম করছে মার্কো পোলো। ২০২০ সালের গোড়ার দিকে, সিএমভি দুটি নতুন ক্রুজ জাহাজ অধিগ্রহণের ঘোষণা দেয়। সেসময়ই কভিড-১৯ মহামারী আঘাত হানে। তখনও মার্কো পোলো সমুদ্র যাত্রা করছিল। করোনার ভাইরাসের সময় মন্দার কারণে সিএমভি কোম্পানি ভেঙে যায়।
সিএমভির সকল জাহাজ নিলামে বিক্রি হয়। সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পার্সিয়ান উপসাগর অভিমুখে যাত্রা করে মার্কো পোলো। শোনা যায় দুবাইতে ব্যবহার করা হবে জাহাজটি। তবে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে এটি কেবল একটি বিরতি। সপ্তাহান্তে, মার্কো পোলো তার যাত্রা শুরু করে। তাঁর এআইএস জানায় ভারতের আলাংগে যাচ্ছে জাহাজটি। জাহাজ ভাঙার জন্য স্থানটি বিখ্যাত। এখানে দীর্ঘ ক্যারিয়ারের অবসান ঘটতে যাচ্ছে কিংবদন্তিতূল্য জাহাজের। ৯ জানুয়ারির মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছার কথা মার্কো পোলোর।
Leave a Reply