বাংলাদেশ এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিজে অসংখ্য অভিজ্ঞ কর্মী বাহিনী রয়েছে কিন্তু বিশেষজ্ঞজনের অভাব অনুধাবন করছে। উল্লেখযোগ্য এই সেক্টর স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও খুব বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐকান্তিক ইচ্ছের ফসল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর যাত্রা। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয় লাভের এক মাসের মধ্যেই ৪ জানুয়ারি ১৯৭২-এ বঙ্গবন্ধু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স প্রতিষ্ঠা করেন। জাতীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সটি ৪ ফেব্র“য়ারি ১৯৭২ প্রথম বারের মতো ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করে। বিমান বাংলাদেশ এর বয়স প্রায় ৪৯ বছর। বর্তমানে জাতীয় বিমান সংস্থার বহরে রয়েছে ১৯টি এয়ারক্রাফট এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৬টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে, যা সময়ের তুলনায় খুবই কম। অথচ বাংলাদেশের সাথে ৪২ দেশের বিমান চলাচলের জন্য এয়ার সার্ভিস এগিমেন্ট আছে। এক যুগ পূর্বেও ২৭-২৮টি গন্তব্যে বিমান যোগাযোগ ছিলো।
কয়েকটি আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থার কথা উল্লেখ করলেই আমরা কতটুকু অগ্রসর হয়েছি কিংবা পিছিয়েছি তা অনুধাবন করা সহজ হবে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের এমিরেটস ১৯৮৫ সালে যাত্রা শুরু করে বিশ্বের অন্যতম বিমান সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিষ্ঠার ৩৫ বছর পর বর্তমানে ১৫৭টি গন্তব্য ও বিমান বহরে ২৫৪টি এয়ারক্রাফট রয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠানে। মাত্র ২৬ বছর আগে ১৯৯৩ সালে যাত্রা আরম্ভ করা কাতার এয়ারওয়েজ ২৩৭টি এয়ারক্রাফট দিয়ে ১৭২টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। ১৯৬৫ সালে মালয়েশিয়া থেকে স্বাধীন হওয়ার ৭ বছর পর ১৯৭২ সালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স এককভাবে যাত্রা শুরু করে। ৪৮ বছর পর বর্তমানে ১৪২টি এয়ারক্রাফট নিয়ে বিশ্বের অন্যতম সেরা এয়ারলাইন্স হিসেবে ১৩৭টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স। তেমনিভাবে থাই এয়ারওয়েজ ১৯৬০ সালে যাত্রা শুরু করে গত ৬০ বছরে ৬১টি এয়ারক্রাফট নিয়ে ৬২টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকান এয়ারলাইন্স মাত্র ২২ বছরে ২৪টি উড়োজাহাজ দিয়ে ৯৬টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে; যা সত্যিই প্রেরণাদায়ক। মাত্র ৮ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত মালিন্দো এয়ারের বর্তমানে উড়োজাহাজের সংখ্যা ২৬ আর গন্তব্য ৬৯টি। সেই সঙ্গে এয়ার এশিয়া এশিয়ার অন্যতম এয়ারলাইন্স হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। মাত্র ২৭ বছরে বিশ্বের প্রায় ১৬৫টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে ২৫৫টি উড়োজাহাজ সংযুক্ত করতে সক্ষম হয়েছে। উড়োজাহাজ ও গন্তব্য উভয়েই বৃদ্ধি করার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এয়ার এশিয়া।
গত ৮ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের অন্যতম বেসরকারি এয়ারলাইন্স নভো এয়ার এর বহরে রয়েছে ৭টি উড়োজাহাজ আর আন্তর্জাতিক গন্তব্য মাত্র একটি, তা হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা এবং ঢাকা থেকে ৭টি অভ্যন্তরীণ গন্তব্য। যা সময়ের তুলনায় খুব বেশী বিস্তার লাভ করতে পারেনি।
এখানে উল্লেখ্য যে, ৬ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের সবচেয়ে নবীনতম এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলার বহরে রয়েছে মোট ১৩টি এয়ারক্রাফট আর ৯টি আন্তর্জাতিক গন্তব্য। খুব সহসাই আরো ৩টি আন্তর্জাতিক গন্তব্য ও বহরে চারটি উড়োজাহাজ যোগ হতে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ৭টি অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে নতুন কোনো বিমানবন্দর প্রতিষ্ঠা পায়নি কিন্তু পূর্বের চালু কিছু বিমানবন্দর বন্ধ হয়ে গেছে। তার মধ্যে রয়েছে ঠাকুরগাঁও, কুমিল্লা, ঈশ্বরদীসহ আরো বেশ কয়েকটি স্টল এয়ারপোর্ট। যাত্রী চাহিদার কথা বিবেচনা করে প্রায় সবগুলো বিমানবন্দরকে আধুনিকায়ন করার কাজ করছে বর্তমান সরকার। সময়ের পরিক্রমায় গত ছয় বছরে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী সংখ্যা বেড়েছে প্রায় তিনগুণ। ২০১৩ সালে যেখানে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী সংখ্যা ছিলো প্রায় সাড়ে ছয় লক্ষ, সেখানে ২০১৮-২০১৯ সালে যাত্রী সংখ্যা প্রায় বিশ লক্ষের কাছাকাছি। যা এভিয়েশনের প্রতি যাত্রীদের আকর্ষণ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতাই স্পষ্ট।
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ বিমানসংস্থাগুলো বিশেষ করে এমিরেটস, কাতার এয়ারওয়েজ, টার্কিশ এয়ারওয়েজ, সৌদি এয়ারলাইন্স, ইত্তেহাদ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্স, থাই এয়ারওয়েজ, গালফ এয়ার, কুয়েত এয়ারওয়েজসহ অনেক নামকরা এয়ারলাইন্স এর অন্যতম গন্তব্য বাংলাদেশ। বাংলাদেশের এভিয়েশন মার্কেটের প্রায় ৭০ ভাগই বিদেশি এয়ারলাইন্স এর কাছে। আর বাংলাদেশি বিমান সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সসহ দেশীয় এয়ারলাইন্স এর কাছে মাত্র ৩০ শতাংশ। যা সত্যিই ভাববার বিষয়। শুধু যাত্রী পরিবহন নয় কার্গো খাতের ও একই দশা। প্রতি বছরই অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটেই যাত্রী বাড়ছে। যাত্রী বৃদ্ধির হারকে পরিপূর্ণ সেবা দেয়ার লক্ষ্যেই হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৈরি হচ্ছে থার্ড টার্মিনাল। বর্তমান টার্মিনালদ্বয়ের থেকে যে সেবা যাত্রী সাধারণ পাচ্ছে তার প্রায় চারগুণ সেবা দেয়ার জন্যই প্রস্তুত হচ্ছে থার্ড টার্মিনাল। ২০২৩ সাল এর মধ্যে এই টার্মিনাল পরিপূর্ণতা পেলে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি অন্যতম সেরা বিমানবন্দর হিসেবে পরিগণিত হবে, যা বাংলাদেশ এভিয়েশনে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশ বিমান এক সময় নিউইয়র্ক, টরেন্টো, আমস্টারডাম, রোম, টোকিও, হংকংসহ বিশ্বের অনেক উল্লেখযোগ্য গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করতো যা দেশের ও জাতীয় বিমানসংস্থার জন্য ছিলো ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার মতো। কিন্তু সময় যত এগিয়ে গেছে ততই একে একে উল্লেখযোগ্য রুটগুলো লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করা হয়েছে; যা দেশের জন্য বিশেষ করে বাংলাদেশ এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিজ এর জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
সমসাময়িক কালে বিশ্বের বিভিন্ন বিমান সংস্থা যেখানে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রেখেছে সেখানে বাংলাদেশের বিমান সংস্থাগুলো কেনো পারছিলো না তা পরিপূর্ণভাবে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞদের দিয়ে যথার্থতা যাচাই করতে ব্যর্থ হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়েছে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশ বিমানকে নতুন নতুন আধুনিক উড়োজাহাজ ক্রয় করে ব্যবসায় এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। যা বাংলাদেশের এভিয়েশনের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এর কৃতিত্বের সিংহভাগই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলেইন্সের বয়স প্রায় ২৫ বছর। এই সময়ের মধ্যে জিএমজি এয়ারলাইন্স, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, বেস্ট এয়ারসহ ৭-৮টি এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সম্প্রতি ১০ বছর বয়সী রিজেন্ট এয়ারওয়েজ সাসপেনশনে আছে। কবে নাগাদ এয়ারলাইন্সটি বাণিজ্যিকভাবে প্রত্যাবর্তন করবে কিংবা আদৌ প্রত্যাবর্তন করবে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট আলোচনা আছে এভিয়েশন মার্কেটে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের এভিয়েশন খাতের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় পুঁজিবাজারে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজে বিনিয়োগ করে নিঃস্ব হয়ে গেছে অনেকে। আবার পরিত্যাক্ত এয়ারক্রাফটগুলো বিমান বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে গলার কাঁটা হয়ে দাড়িয়ে আছে যা, বছরের পর বছর বিমানবন্দরের টারমাকের অনেক জায়গা দখল করে আছে। যার ফলে চলমান এয়ারলাইন্সগুলোর এয়ারক্রাফটগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্যও পর্যাপ্ত জায়গার ও সংকুলান হচ্ছে না।
প্রাইভেট এয়ারলাইন্স বিশেষ করে প্যাসেঞ্জার এয়ারলাইন্স এর জন্য গত ২৫ বছরে হ্যাংগার সুবিধা ছিলো না। সম্প্রতি হ্যাংগার তৈরির কাজ চলছে, এতে বেসরকারি এয়ারলাইন্স তাদের উড়োজাহাজগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারবে সহজেই। বেসরকারি এয়ারলাইন্সের বহুদিনের দাবি এ্যারোনোটিক্যাল ও নন-এ্যারোনটিক্যাল চার্জগুলো অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটের জন্য যৌক্তিক হারে নির্ধারণ করলে বাংলাদেশের বিমান সংস্থাগুলো বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সহজ হবে। সেই সংগে জেট ফুয়েল এর দামও আন্তর্জাতিক বাজারের সাথে সামঞ্জস্য রেখে নির্ধারণ করলে দেশীয় এয়ারলাইন্স এর অগ্রযাত্রায় সহায়ক হবে। সম্প্রতি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজসহ ইরাক, ইরান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়ার এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। দেশের এভিয়েশন মার্কেট বড় হচ্ছে কিন্তু বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলোর মার্কেট শেয়ার আশানুরূপ অগ্রসর হচ্ছে না। অথচ বাংলাদেশের যাত্রীদের নিয়ে সব বিদেশি এয়ারলাইন্সই ব্যবসা করে যাচ্ছে। সেখানে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞ জনের সহায়তার মাধ্যমে সমস্যার যথার্থতা নিরূপণ করে দেশীয় এয়ারলাইন্সকে বিদেশি এয়ারলাইন্স এর সাথে যেন প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে, সেই কার্যক্রম হাতে নেয়া খুবই জরুরি। এভিয়েশন সেক্টরের উন্নয়ন ঘটানো গেলে দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো সহজতর হবে, হোটেল ইন্ডাস্ট্রিজ বেগবান হবে। এ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রত্যেকটি খাত বিশেষ করে ট্রাভেল এজেন্ট, ট্যুর অপারেটর কোম্পানিতে অধিক সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ হবে, বেকারত্বের হার কমাতে সহায়তা করবে।
লেখক : মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স।
Leave a Reply