করোনা সংক্রমণের বিধিনিষেধে কার্যত ঘরবন্দী মানুষ। বাংলাদেশে এ অবস্থা চলছে প্রায় এক বছর। পরিবার-পরিজন নিয়ে হাঁপিয়ে ওঠার অবস্থা। আশার কথা, বর্তমানে চলছে টিকাদান, সংক্রমণও নিম্নমুখী। এমন পরিস্থিতিতে ভ্রমণপিপাসুদের জন্য বাড়তি সুযোগ এনে দিয়েছে সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। তিন দিনের সরকারি ছুটিতে ঢল নেমেছে দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে। এসব এলাকার হোটেল-মোটেল ও রেস্ট হাউজে নেই কোনো জায়গা। শুক্রবার থেকেই বেড়েছে ভিড়। অনেকে শুক্র, শনি ও রবিবারের অগ্রিম বুকিং দিয়ে পরিবার নিয়ে এসেছেন বেড়াতে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো আগেভাগেই পর্যটকদের সামলাতে ব্যবস্থা নেয়। করোনা সংক্রমণ মাথায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়ে তৎপরতা ছাড়াও পর্যটন কেন্দ্র সংশ্লিষ্ট এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে।
সিলেটের নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, তিন দিনের ছুটি কাটাতে সিলেটে পর্যটকদের ঢল নেমেছে। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ সপরিবারে সিলেটে আসতে শুরু করে। গতকাল সিলেটের জাফলং, বিছনাকান্দি, ভোলাগঞ্জসহ বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানে এবং চা বাগানগুলো দিনভর মুখরিত ছিল পর্যটকদের পদচারণায়। পর্যটকদের চাপে গতকাল ছুটির দিনেও সিলেট নগরীতে যানজট দেখা দেয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নগরীর হোটেল-মোটেল, রেস্ট হাউজগুলোর সব সিট বুকড হয়ে গেছে। অনেকে সিট না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন। নরসিংদী থেকে সপরিবারে বেড়াতে আসা আহমেদ আদনান বলেন, করোনার কারণে ঘরে থাকতে থাকতে সন্তানরা হাঁপিয়ে উঠেছিল। এজন্য তিন দিনের এ ছুটি ঘিরে আগেই পরিকল্পনা করেছিলাম। সিলেটে বেড়াতে এসে অনেক ভালো লাগছে। বাচ্চারা খুবই আনন্দ করছে।
খুলনার নিজস্ব প্রতিবেদক জানিয়েছেন, তিন দিনের ছুটিতে সুন্দরবনে পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে। আগে যেখানে প্রতিদিন ৩০-৪০টি লঞ্চ যেত, এখন সেখানে প্রতিদিন ৫০টি লঞ্চ যাচ্ছে। করোনার কারণে দেশি পর্যটকদের আনাগোনা বেশি।
ট্যুর অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন অব সুন্দরবনের সাধারণ সম্পাদক এম নাজমুল আযম বলেন, ‘১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি তিন দিনের জন্য আমাদের লঞ্চগুলো প্রায় দুই মাস আগেই ভাড়া হয়ে গেছে। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে ২১ ফেব্রুয়ারির ছুটি হওয়ায় সুবিধা হয়েছে। পর্যটকদের বেশিরভাগই সুন্দরবনের কটকা, কচিখালি, হাড়বাড়িয়া ও করমজলে ভিড় করছেন।’
তিন দিনের ছুটিতে কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকতে কয়েক লাখ পর্যটক এসেছেন। গতকাল তিলধারণের ঠাঁই ছিল না বিশ্বের দীর্ঘতম এ সৈকতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশ কয়েক দিন আগেই আগাম বুকিং হয়ে আছে সাড়ে চার শতাধিক হোটেল-মোটেল-রিসোর্ট। এসব হোটেল-রিসোর্টে দেড় লাখ মানুষের রাতযাপনের সুযোগ রয়েছে।
পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছে ট্যুরিস্ট ও জেলা পুলিশের দল। মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত পুলিশও। যেকোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে সিসিটিভির আওতায় আনা হয়েছে পর্যটন স্পটগুলো।
হোটেল হোয়াইট অর্কিডের মহাব্যবস্থাপক রিয়াদ ইফতেকার জানান, টানা তিন দিনের ছুটি পেয়ে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পর্যটক কক্সবাজারে এসেছেন। সাড়ে চার শতাধিক হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টের সব অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, সৈকতের লাবণী, সুগন্ধা, কলাতলীসহ ১১টি পয়েন্টে তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। পর্যটকদের করোনা সংক্রমণ রোধে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সচেতনতামূলক মাইকিং ছাড়াও ভ্রাম্যমাণ আদালত তৎপর রয়েছে।
পটুয়াখালী প্রতিনিধি জানিয়েছেন, টানা তিন দিনের ছুটিতে কুয়াকাটায় ভিড় করেছেন দেশি-বিদেশি হাজারো পর্যটক। প্রকৃতির টানে সাগরকন্যায় ছুটে আসা এসব মানুষ পড়ছেন বিড়ম্বনায়। আগাম বুকিং না দেওয়ায় অনেকে হোটেলের রুম পাননি। ফলে শিশু, নারী, বয়স্ক অনেককে হোটেলের রুম পেতে ছোটাছুটি করতে হয়েছে। অনেকে বাড়তি ভাড়া দিয়ে নিম্নমানের রুম ভাড়া করেছেন। খাবারের দামও চড়া। শুঁটকি, ঝিনুক ব্যবসায়ীসহ ক্যামেরাম্যান, মোটরসাইকেল চালকরা জানান, পর্যটকদের ভিড় সামলাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
কুয়াকাটা ট্যুরস অপারেটর অ্যাসোসিয়েশন টোয়াকের সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ‘গত বুধবার থেকেই ট্যুরিস্টরা আসতে শুরু করেন। বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে তা জনস্রোতে রূপ নেয়। প্রত্যাশার চেয়ে পর্যটকের ভিড় বেশি। এরপরও সাধ্য অনুযায়ী সবাইকে আন্তরিক সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
রাঙ্গামাটি প্রতিনিধি জানিয়েছেন, টানা তিন দিনের ছুটিতে জেলার বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ভিড় বেড়েছে। ১৯, ২০ ও ২১ ফেব্রুয়ারি তিন দিন কোনো হোটেল-মোটেলে আসন ফাঁকা নেই। বেশিরভাগ পর্যটক জেলার অন্যতম আকর্ষণ ঝুলন্ত সেতু দেখতে আসছেন। সবমিলে বর্তমানে জেলায় ১৫ থেকে ২০ হাজার পর্যটক অবস্থান করছেন।
রাঙ্গামাটি পর্যটন করপোরেশনের ব্যবস্থাপক সৃজন কান্তি জানান, শুধু গতকাল পাঁচ হাজারের বেশি পর্যটক ঝুলন্ত সেতুতে উঠেছেন। সামনের দুদিন এ সংখ্যা আরও বাড়বে। পর্যটকদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, জেলার লৌহজং উপজেলার শিমুলিয়াঘাটে দক্ষিণবঙ্গের ঘরমুখো যাত্রীরা ভিড় করেন। তারা দিনভর ফেরি, লঞ্চ ও স্পিডবোটে পদ্মা পাড়ি দেন। বাড়তি যাত্রীর চাপে হিমশিম খেতে হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। গতকাল দুপুর নাগাদ শিমুলিয়া ঘাটে ৮০০ যানবাহন পারাপারের অপেক্ষায় থাকতে দেখা যায়।
বিআইডব্লিউটিসির শিমুলিয়া ঘাটের ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) সাফায়েত আহমেদ জানান, এ নৌরুটে ১৩টি ফেরি চলাচল করে। সকাল থেকেই বাড়তি যানবাহন ও যাত্রীর চাপ দেখা দেয়। তিন দিনের ছুটি পেয়ে দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোর যাত্রীরা বাড়ি ফেরায় এ চাপ দেখা দেয় বলে জানান তিনি।
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া নৌরুটে যানবাহনের চাপ বেড়েছে। গতকাল বেলা ৩টার দিকে শুধু পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় পারের অপেক্ষায় আট শতাধিক যানবাহন ছিল। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছোট গাড়ি, বাস পারাপার করা হলেও সাধারণ পণ্যবাহী ট্রাক সাময়িক বন্ধ রেখেছে ঘাট কর্তৃপক্ষ।
বিআইডব্লিউটিসির আরিচা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত ডিজিএম মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘শুক্রবার এমনিতেই বাড়তি চাপ থাকে। ২১ ফেব্রুয়ারি মিলে তিন দিন সরকারি ছুটির কারণে তা আরও বেড়েছে।’
জেলা ট্রাফিক পুলিশের পাটুরিয়া ঘাট এলাকার কন্ট্রোল রুম জানায়, বেলা ৩টা পর্যন্ত পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় শতাধিক যাত্রীবাহী বাস, তিন শতাধিক ব্যক্তিগত গাড়ি, তিন শতাধিক পণ্যবোঝাই ট্রাক ও উথুলি সংযোগ মোড়ে আরও শতাধিক পণ্যবোঝাই ট্রাক ফেরি পারাপারের অপেক্ষায় ছিল। ১৬টি ফেরির মাধ্যমে এগুলো পারাপার করা হচ্ছে।
Leave a Reply